আরিয়ানের অ্যাপের দুনিয়া
- বিজ্ঞান প্রযুক্তি ডেস্ক
রাফিদ আরিয়ান এসএসসি পাস করেছে বেশি দিন হয়নি। এরই মধ্যে হয়ে গেছে পেশাদার অ্যাপ ডেভেলপার। করছে আরো অনেক কিছু।
অনলাইন মার্কেট প্লেসে আরিয়ানের মোট ১৩টি ওয়েব অ্যাপ আছে। আবার সরকারের আইসিটি দপ্তরেও জমা দেওয়া আছে কৃষিভিত্তিক অ্যাপ ‘সবুজের কাছাকাছি’।ওয়েব অ্যাপগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—মা ও শিশু, আর নয় মাদক, অল টুডু, অল আইজ বাংলাদেশ, ইউনিয়ন পরিষদ, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ডিওয়াইডি ইত্যাদি। বেশির ভাগই ওয়েব অ্যাপ।
অ্যাপ নিয়ে আরিয়ান জানাল, ‘অ্যাপগুলো মানুষের উপকারে আসবে। মা ও শিশু অ্যাপটিতে আছে গর্ভকালীন সব তথ্য। জরুরি অবস্থায় কী করতে হবে, খাবার তালিকা, নবজাতকের যত্ন ও বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সমস্যার সমাধান। আর নয় মাদক অ্যাপটিতে মাদকের কুফল বর্ণনা করা আছে।’
আরিয়ানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এত এত অ্যাপ বানানো ও অন্য সব কাজ করতে গিয়ে দিনের একটা বড় সময় পড়ে থাকতে হয় কম্পিউটারের সামনে। ‘এর জন্য সারা দিন মায়ের বকুনি খাই। আর এর শুরুটা ২০১৪ সালে। জেএসসির তিন-চার মাস আগ থেকে। ওই সময় গেমের পেছনে অনেক সময় দিতাম। ’ আরিয়ান আরো জানাল, শুধু খেলার জন্য নয়, সে চাইত গেমের ভেতরের খুঁটিনাটি যদি বদলে দেওয়া যেত। ‘অনেক গেমের ডাটা এডিট করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছি। তবে আগ্রহ হারাইনি। ক্লাস এইটে ওঠার পর আগ্রহ জন্মায় প্রগ্রামিংয়ের ওপর। বাসায় তখনো ইন্টারনেট ছিল না। তাই শেখার উপকরণ পেতে সমস্যা হয়েছিল অনেক। ইউটিউবের টিউটরিয়াল দেখার সুযোগও ছিল না। ছিল না কোনো ওয়েবসাইটে ঢোকার সুযোগ। কিন্তু আমার আগ্রহ দেখেই মা-বাবা বাসায় নেট এনে দেন। শুরু হয় প্রগ্রামিং চর্চা। শুরুতে কিছুই মাথায় ঢুকত না। কিছুটা শেখার পর প্রথমবারের মতো অংশ নিই জাতীয় প্রতিযোগিতায়। ওটা ছিল ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন সফটওয়্যার ইনোভেশন। সেখানে পুরস্কার না পেলেও নতুন অনেক কিছু শিখে আসতে পেরেছিলাম।’
‘তখনো ভাবিনি, অ্যাপ নিয়েই কাজ করব। কিছুদিন পর প্রথম জানতে পারি, মজিলা বাংলাদেশের কথা। ভাগ্যক্রমে জেনে যাই যে কিছুদিন পরই তাদের অ্যাপ চ্যালেঞ্জ হবে। দেরি না করে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলি। ডাক আসে অ্যাপ চ্যালেঞ্জে। আমিই ছিলাম সেখানে সবচেয়ে খুদে অ্যাপ ডেভেলপার। তখন মূলত শেখার জন্য অংশ নিই। ইউআই, ইউএক্স, কোডিং ও কোন অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করব তা জানতে থাকি। আমি মূলত ফায়ার ফক্স ওএস নিয়ে কাজ করতাম। যদিও এখন অ্যানড্রয়েড নিয়েও কাজ করা হয়। ধীরে ধীরে অনলাইন বাজারে আমার অ্যাপগুলো আসতে থাকে। তবে আমি মূলত বাংলা অ্যাপ নিয়ে কাজ করি। চাই সব সেবা বাংলায় দিতে।’
আরিয়ানের মতে, তার বানানো অ্যাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সফল অল টুডু (All ToDo)। কী হবে এটা দিয়ে? আরিয়ানের উত্তর—‘এটি মূলত আপনাকে কাজের সময় মনে করিয়ে দেবে। চাইলে যেকোনো কিছু এতে লিখে রাখতে পারবেন। এর ইউজার ইন্টারফেস বেশ মসৃণ। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই ব্যবহার করা যাবে এটি। আর এটি বানিয়েছে আমার বয়সী ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবেই। তারা যেন তাদের সময়টা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারে।’
আরিয়ানের আরেক ইচ্ছা হলো, অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষরাও যেন তার অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে। সবুজের কাছাকাছি অ্যাপটির পরীক্ষামূলক সংস্করণে বাংলায় অডিও শোনার ব্যবস্থা আছে। ‘গ্রামের কৃষকদের উপযোগী করেই বানাই অ্যাপটি। অ্যাপটি সরকারের আইসিটি সেক্টরে জমা দেওয়া আছে। সবুজের কাছাকাছির দ্বিতীয় সংস্করণ বানাতে আমাকে বেশ সহায়তা করেছে আমার স্কুলের জুনিয়র অনির্বাণ সিয়াম। সে-ও আমার সঙ্গে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। তাকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়।’
এর মধ্যে প্রায় শতাধিক ইভেন্টে অংশ নিয়েছে আরিয়ান। এর মধ্যে আছে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, স্লভে থন, ইয়েটেল অ্যাপ চ্যালেঞ্জ, মজিলা অ্যাপ চ্যালেঞ্জ, গুগল আই ও রিকেপ, জিডিজি ডেভফেস্ট, ইন্টারনেট সপ্তাহ, ইথিকেল হ্যাকিং সেমিনার, ইউথ ফেস্ট ইত্যাদি। আর স্কুল-কলেজগুলোর ফেয়ার তো আছেই।
মজিলা বিডি, গুগল ডেভেলপার গ্রুপ বাংলাসহ অর্ধশতাধিক সংগঠনের সদস্য রাফিদ আরিয়ান। এর মধ্যে নিজের আছে একটি সৃজনশীল উন্নয়ন সংগঠন। নাম রেখেছে কাশফুল ফ্যাক্টরি। এটি মূলত আরিয়ানের বন্ধু ও কিছু জুনিয়রকে নিয়েই চলছে। কাশফুল ফ্যাক্টরি নিয়ে আরিয়ান জানাল, ‘আমাদের টার্গেট নতুন প্রজন্মের সৃজনশীল মেধাকে আরেক ধাপ ওপরে নিয়ে যাওয়া। তরুণ উদ্যোক্তা গঠন থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাশফুল ফ্যাক্টরি কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা কতগুলো ইভেন্ট করেছি সফলভাবে। এই মাসের শেষ নাগাদ কিছু প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হবে। আর এ সংগঠন দাঁড় করানোর পেছনে সিয়াম, মিমো, তাফসির আর মায়শার অবদানের কথা না বললেই নয়।’
নতুন প্রজেক্ট সম্পর্কেও টুকটাক জানাল আরিয়ান। ‘এটি চালানো হবে দেড় শতাধিক গ্রামের স্কুলে। সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের টুকিটাকি শেখানো হবে। আর ওটা দেওয়া হবে সম্পূর্ণ আমাদের নিজেদের তৈরি বাংলা কনটেন্ট দিয়ে।’
এখন এই কাশফুল ফ্যাক্টরির প্রজেক্ট নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছে আরিয়ান ও তার দল। এ ছাড়া অ্যাপ ডেভেলপিং আর গ্রাফিকস ডিজাইনিং তো আছেই।
এত কিছুর সময় আসে কোথা থেকে জানতে চাইলে আরিয়ান বলে, ‘মা-বাবার সাপোর্ট একটা বড় বিষয়। আমার এখনো মনে আছে, যখন মজিলা অ্যাপ চ্যালেঞ্জ ছিল, তখন আমার জেএসসি চলছিল। পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই বাবা এক দৌড়ে আমাকে নিয়ে যেত অ্যাপ চ্যালেঞ্জের ভেন্যুতে। কোডিং প্র্যাকটিস, অ্যাপ বা কোনো কিছুর আইডিয়া বের করা, নিজের অর্গানাইজেশনের কাজ; আবার বিভিন্ন সংস্থার কাজ, এর মধ্যেই খাওয়া-ঘুম। পড়ালেখা আর বিনোদনের জন্যও সময় বরাদ্দ আছে। তবে কাশফুল ফ্যাক্টরির কোনো ইভেন্ট, অ্যাপ চ্যালেঞ্জ, ওয়ার্কশপ, সেমিনার বা বিশেষ প্রজেক্ট থাকলে ব্যস্ততা বাড়ে। তবে পরে অবসরে সব ঠিক করে ফেলি। অবশ্য পড়াশোনায় অত ভালো ফল করতে পারিনি। জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ ৫ আসেনি। তবে আমি ভেঙে পড়িনি। আমি আমার অ্যাপের দুনিয়ায় ভালো করতে চাই। তবে এর জন্য মা-বাবা ও বন্ধুদের অবদান অনেক। ’
স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে যারা অ্যাপ ডেভেলপিংয়ে আসতে চায়, তাদের জন্য পরামর্শ রয়েছে আরিয়ানের। ‘অনলাইন বাজারে কিন্তু অগণিত অ্যাপ আছে। তাই আগে মাথা খাটিয়ে বের করতে হবে কী নেই। যেমন আমার টার্গেট বাংলায় অ্যাপ বানানো। সেটি যেমনই হোক। আগে একটা জিনিস মাথায় রাখবে—তোমার অ্যাপটি কারা ব্যবহার করেবে, তারা কী চায়, তা-ও জানতে হবে। যাকে বলে—পেপারওয়ার্ক করতে হবে। তাহলে দেখবে, তোমার অ্যাপ সত্যিই মানুষের উপকারে আসবে। ’
‘আবার অ্যাপ বিভিন্ন রকম হয়। যেমন—ওয়েব অ্যাপ, অ্যানড্রয়েড অ্যাপ, আইওএস অ্যাপ। তুমি যদি জাভা ও ওয়েবভিত্তিক প্রগ্রামিং ভাষাগুলো শিখে ফেলো, তাহলে সবই বানাতে পারবে। তোমাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ ইউটিউব আছে হাতের নাগালে। আছে অসংখ্য সাইট। টিউটরিয়াল থেকে শুরু করে নমুনা কোড, নিয়ম, ফ্রেমওয়ার্ক, টেমপ্লেট—সবই আছে। এগুলো খুঁজে বের করতে গুগল মামা তো আছেই!’ যোগ করল আরিয়ান।
এর মধ্যে আবার বিনোদনের জন্যও সময় বরাদ্দ আছে আরিয়ানের। তবে সেখানেও বিশেষ পছন্দের তালিকা আছে। বিখ্যাতদের জীবনী, প্রামাণ্যচিত্র ও প্রযুক্তি বিষয়ে যেকোনো সিনেমা গোগ্রাসে গিলতে দেরি হয় না তার। এই ফাঁকে আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখা যায়, আরিয়ান একটু কম কথা বলার মানুষ। এ কারণে বন্ধুরা নাকি তাকে আড়ালে এলিয়েন বলে ডাকে!