টিকটক লাইকিতে মানসিক সমস্যা

টিকটক লাইকিতে মানসিক সমস্যা

  • ঋতুপর্ণা চাকী

টিকটক এখন তরুণ থেকে বৃদ্ধ যেকোনো প্রজন্মের মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি অ্যাপ। কেউ এটি ব্যবহার করছে সহজে অর্থ উপার্জনের জন্য, অবার কেউ এটি ব্যবহার করছে শখের বসে সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু অতিরিক্ত টিকটকে আসক্তি হয়ে উঠছে মানসিক সমস্যার কারণ। এটি আমাদের সমাজের জন্যও হতে পারে একটি ক্ষতিকর দিক।

বর্তমানে একটি স্মার্ট ফোন তো কম বেশি সবার হাতেই দেখতে পাই। কিন্তু কিছু বছর আগেও মোবাইল ফোন আমাদের কাছে ছিল শুধুমাত্র দূরবর্তী মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলে যোগাযোগ করার একটি যন্ত্র। 

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে আমরা এখন পেয়েছি আমাদের হাতের স্মার্ট ফোনটি। এটি এখন আর শুধু কথা বলার যন্ত্র নয়। এর সাহায্যে আমরা এখন আমাদের মনমতো করতে পারছি ছবি তোলা থেকে শুরু করে ভিডিও বানানোসহ অনেক কাজ। টিকটক লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে আমাদের তরুণ সমাজ আবার রাতারাতি হয়ে যাচ্ছে তারকা বা টিকটক স্টার। তারা নিজেদেরকে দাবি করছে সেলিব্রিটি বলেও।

প্রশ্ন উঠেছে এসব ভিডিওর গুনগত মান নিয়ে। কতোটুকু  মানসম্মতভাবে ব্যবহার করছে তরুণ সমাজ এই টিকটককে। শহর অথবা গ্রামের রাস্তায় বিভিন্ন অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গীর ভিডিও ধারণ করতে দেখে আমরা অনেকেই হয়তো অবাক হই। কতো সাবলীলভাবে তারা তৈরি করছে এসব অদ্ভুত ভিডিও। টিকটকের জন্য ধারণ করা এই ভিডিওগুলো সামাজিক কোনো নিয়ম শৃঙ্খলাকে তোয়াক্কা না করেই তৈরি করা হচ্ছে এখন। কখনো তৈরি করা হচ্ছে অশ্লীল সব নাচের ভিডিও বা কখনও তৈরি করা হচ্ছে ব্যঙ্গাত্নক সব ভিডিও। স্বাভাবিক কথাও বলছে ব্যঙ্গাত্নকভাবে। এসব ভিডিওতে থাকে না শিক্ষণীয়  কোনো  কিছুই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের টিকটক বা লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে আমাদের তরুণ সমাজের কোনো উপকার তো হচ্ছেই না, উল্টো তারা অদ্ভুত এক ধরনের ব্যঙ্গাত্নক আচরণ আয়ত্ত্ব করছে। দিনের বেশির ভাগ সময় তারা এসবের পিছনে ব্যয় করছে। এর ফলসরূপ তারা পড়াশোনায় হয়ে যাচ্ছে অমনোযোগী এবং টিকটক লাইকিকেই তারা ভবিষ্যত ক্যারিয়ার বলে নির্বাচন করছে।

শুধু তরুণরাই নয়, টিকটকের প্রতি আসক্তি আমরা বিভিন্ন বয়সী মানুষসহ বড় বড় সেলিব্রিটি, শিক্ষার্থী, গৃহিণী সবার মধ্যেই দেখতে পাই। এখন তো খবরের পাতা খুললেই আমাদের চোখে পড়ে অতিরিক্ত টিকটক আসক্তির কারণে স্বামী তার স্ত্রীকে খুন করেছে, বা অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ। এসব ঘটনা তো প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে।

টিকটকের কেন এত জনপ্রিয়

টিকটকে এসব ভিডিও ভাইরাল হলে বা ভিউ বেশি হলে সহজে এখান থেকে টাকা আয় করা যায়। এটিকে টিকটকে আসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এখন মানুষ নিজের একাকিত্ব থেকে বের হতে এবং মানুষের থেকে এটেনশন পেতে টিকটক বা লাইকিকে প্রধান হাতিয়ার বলে মনে করছে। কারণ টিকটক বা লাইকির মাধ্যমে একদিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠা সম্ভব। 

এরকমই একজন টিকটক স্টার নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জান্নাত। লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রথমে সময় কাটানোর জন্য সে টিকটক বানাতে শুরু করে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তার ভিডিওগুলো ভাইরাল হয় এবং তার ফ্যান ফলোয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার ফলোয়ার সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। প্রতিদিন এখন সে আট থেকে দশটি করে ভিডিও আপলোড করে টিকটকে।

এ বিষয়ে তার মা বাবার সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে শখ করে ভিডিও বানাতো জান্নাত, কিন্তু এখন এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এগুলো করতে মা বাবা তাকে নিষেধ করলেও কোনো ফল হয়নি। দিনের অধিকাংশ  সময়ই সে টিকটকের  পিছনে  ব্যয় করছে। ফলে বাবা মার সাথেও তার দূরত্ব বাড়ছে দিন দিন।

টিকটকের প্রভাব

টিকটক ভিডিও তৈরি করেন, তাদের উপর পড়ছে টিকটকের অনেক প্রভাব। অনেক  সময় তারা বিভিন্ন কনটেন্ট নিয়ে টিকটক ভিডিও  বানায় কিন্তু  আশানুরূপ  ফল না পাওয়ায় তাদের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশার সৃষ্টি হয়। এজন্য  তারা মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে এবং বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে যায়। আবার ভিডিও  বানানোর জন্য  তাদের  অনেকের কাছ থেকেই অনেক কটুক্তির শিকার হতে হয়। এটিও তাদের মানসিক অনেক সমস্যা তৈরি করে।

এ বিষয়ে সময় টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সমাজ ও অপরাধবিজ্ঞানী তৌহিদুর রহমান বলেন, এভাবে যদি কিশোর কিশোরীরা এই ধরনের সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্ত হয় তাহলে ভবিষ্যতে যারা দেশকে নেতৃত্ব দিবে তারা এক প্রকার অসুস্থ হয়েই বড় হয়ে উঠবে। একটা অসুস্থ গোষ্ঠী কিভাবে একটা দেশের নেতৃত্বে জায়গা নেবে? ইতিমধ্যেই এই প্লাটফর্মগুলো বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। তাই আর যাতে এগুলোর বিস্তার না ঘটে তার জন্য সরকারের উচিত এখনই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।

আধুনিক এই প্রযুক্তি বিকাশের যুগে দেশের সামাজিক সংস্কৃতি ঠিক রাখতে ও নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে ইতিমধ্যে ভারতসহ আরো অনেক দেশ টিকটক, লাইকিসহ এমন আরো কয়েকটি অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। 

আমাদের দেশে যেন এরকম জিনিস আর মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে এবং তরুণ প্রজন্ম যেন এগুলোর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বুঝতে পারে এজন্য বাবা মায়ের উচিত তাদের সন্তানদের ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া।

Sharing is caring!

Leave a Comment