নগর নকশা ও পরিবহনে পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যচিত্রে উন্নয়ন সম্ভব
২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জনসংখ্যা এক হাজার কোটিতে উন্নীত হবে। বিশ্বের ৭৫ শতাংশ মানুষ তখন বিভিন্ন শহরে বাস করবে। নগর পরিকল্পনা ও পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপুল এ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য রকম ইতিবাচক উন্নয়ন সম্ভব। নগর পরিকল্পনার দুর্বলতা ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগোর গবেষকরা এ কথা জানিয়েছেন। খবর ল্যানসেট।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতি, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রমণশীল রোগের বিস্তার, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত অসুস্থতা ও স্থূলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঘটছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, দ্রুত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বজুড়ে নেতিবাচক পরিবর্তনের এ পুরো চিত্রপট রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম সম্পর্কে নতুন করে ভাবার দাবি জোরালো করেছে।
আবাসন, খাদ্য, পানি সরবরাহ, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সঞ্চালন, পরিবহন, সমাজসেবা ও চিকিত্সা অবকাঠামো আগামী দিনে বর্ধিষ্ণু নগরবাসীর স্বাস্থ্য, শান্তি ও নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখবে। স্বাস্থ্যচিত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই নগর পরিকল্পনার গুরুত্ব এরই মধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে।
নগর-নকশা, পরিবহন ও নাগরিক স্বাস্থ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে তিন পর্বের এক সিরিজ প্রতিবেদন করছে মর্যাদাশীল সাময়িকী ল্যানসেট। এতে বলা হয়েছে, নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে নাগরিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। বিজ্ঞানভিত্তিক ও নিমিত্তবাদী নগর-নকশা ও পরিবহন ব্যবস্থা স্বাস্থ্য, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক চাপ কমাতে পারে।
বিশ্বজুড়ে তরুণ জনগাষ্ঠীর প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর পেছনে সড়ক দুর্ঘটনা এক বড় কারণ। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ৯০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোয় হয়ে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে ও সড়কে আহতদের চিকিত্সার পেছনে নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোর জিডিপির ৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয়ে থাকে।
হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতার মতো অসংক্রমণশীল রোগ বৃদ্ধি বিশ্বজুড়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮০-২০১৩ সময়কালে সারা বিশ্বে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর স্থূলতার হার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোয় এ সময়ে স্থূলতা বেড়েছে ৬০ শতাংশ। অপরিণত বয়সে মৃত্যুর বড় কারণ স্থূলতা। এ কারণে অকালমৃত্যুর ঝুঁকি স্থূলতার মাত্রাভেদে ৪৫ শতাংশ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
গত ২৫ বছরে বিশেষত নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোয় স্ট্রোকের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। স্ট্রোকের ঘটনার দুই-তৃতীয়াংশের জন্য ধূমপান, অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও শারীরিক পরিশ্রম না করার মতো আচরণিক কারণকে দায়ী করা যায়। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ স্ট্রোকের জন্য দায়ী বায়ুদূূষণ।
বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে। উচ্চরক্তচাপে এক কোটির বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া স্থূলতার কারণে প্রতি বছর ৪৪ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়।
শারীরিক অকর্মণ্যতার কারণে উত্পাদনশীলতা হ্রাস ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ২০১৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৬ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। শারীরিক অকর্মণ্যতার কারণে প্রতি বছর ৫৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
২০১৪ সালে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে ডায়াবেটিসের কারণে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলারের মতো (১ হাজার ৯৯ বিলিয়ন) অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছিল। একইভাবে প্রতি বছর রক্তচাপের কারণে বৈশ্বিক ব্যয়ের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলার।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, নগর-নকশা ও পরিবহনের পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃদরোগ ও ডায়বেটিসের মতো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি দূষণ হ্রাস করা যায়। একইভাবে শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
প্রতিবেদন রচয়িতাদের মতে, যেসব শহরে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ির পরিমাণ বেশি, সেখানে সাইক্লিস্ট ও পথচারীদের প্রণোদনা দেয়া উচিত। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের বাঁচাতে অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি।
বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি এরই মধ্যে শহরে বাস করছে। ২০৫০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের বড় শহরগুলোর জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ, ৩৮ শতাংশ ও ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
ল্যানসেটের সিরিজ প্রতিবেদনটির মুখ্য রচয়িতা ও ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের প্রফেসর মার্ক স্টিভেনসন নিবিড় নগরের একটি মডেল নকশা করেছেন। মডেলে দেখা যায়, একটি নিবিড় নগরে ভূমি ব্যবহার ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি গণপরিবহনের গড় দূরত্ব ৩০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব। একইভাবে ভূমি ব্যবহারে ৩০ শতাংশ বৈচিত্র্য সংযোজন সম্ভব।
মেলবোর্ন, লন্ডন, বোস্টন, সাও পাওলো, কোপেনহেগেন ও দিল্লির ওপর প্রফেসর স্টিভেনসন এ নকশা প্রয়োগ করেন। এর ফলে প্রতিটি নগরেই স্বাস্থ্যচিত্রে উন্নতি দেখা যায়। বিশেষত হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কমতে এবং শারীরিক কর্মকাণ্ড বাড়তে দেখা যায়।
নিবিড় নগর মডেলে পরিবহনের নিঃসরণজনিত বায়ুদূষণও কমতে দেখা গেছে।