কারিগরি প্রশিক্ষণে আগ্রহ বাড়ছে মেয়েদের
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
মেয়েদের কারিগরি প্রশিক্ষণ মানেই সেলাই বা সৌন্দর্যচর্চা—ধীরে হলেও এ ধারণা এখন বদলাচ্ছে। টিভি, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) মেরামত ও সার্ভিসিং, আসবাব তৈরি, হাউস ওয়্যারিংয়ের (ঘরে বৈদ্যুতিক কাজ) মতো বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছেন চট্টগ্রামের অনেক তরুণী। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা এসব পেশায় যুক্তও হচ্ছেন। সমাজে এসব কাজ এখনো ‘পুরুষের কাজ’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম নগরের নন্দন কানন এলাকায় নোভা মার্কেটিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান ইউপিএস ও স্ট্যাবিলাইজার তৈরি করে। সেখানে কাজ করেন পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকার তরুণী লাকি আক্তার। তিনি বলেন, ‘ইলেকট্রনিক অ্যাসেমব্লিংয়ের ওপর যখন প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি, তখন পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই আমাকে নিরুৎসাহিত করেছে। বলেছে, এটি পুরুষের কাজ। কিন্তু আমি কারও কথায় কান দিইনি। এই কাজটা করতে খুব ভালো লাগে।’
অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে লাকি আক্তারের। দুই বছর ঘরের কাজে পরিবারকে সহায়তা করেন। ২০১৫ সালে নগরের একটি প্রতিষ্ঠানে নিজের পছন্দে প্রশিক্ষণ নেন ইলেকট্রনিক অ্যাসেমব্লিংয়ের (টিভি, আইপিএস, ইউপিএস মেরামত, সার্কিট তৈরি ইত্যাদি) ওপর।
লাকির মতো নোভা মার্কেটিংয়ে আরও দুজন নারী কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক সত্যজিৎ চৌধুরী বলেন, প্রশিক্ষণ পাওয়া নারী ও পুরুষের কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং মেয়েরা কাজে তুলনামূলক বেশি মনোযোগী।
প্রচলিত ধারার বাইরের কাজে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি লতিফা কবির বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন যদি নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে কোনো কাজেই নারী-পুরুষ ভেদাভেদ রাখা যাবে না। খুব ধীরে হলেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। কারিগরি পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটি আরও বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে বিমান চালনায় নারীরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা রাস্তায় মাটি কাটছে, কৃষিকাজে অংশ নিচ্ছে। কারিগরি পেশায়ও ভবিষ্যতে মেয়েরা খুব শক্ত অবস্থানে যাবে বলে আশা করেন তিনি।
নগরের নাসিরাবাদে অবস্থিত মেয়েদের সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র চট্টগ্রাম মহিলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে গত জুলাই মাস থেকে জেনারেল ইলেকট্রনিকস বিষয়ে ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়েছে। এই কোর্সের প্রথম ব্যাচে ৪০ জন নারী এখন রেডিও-টেলিভিশন মেরামত, ট্রান্সফরমার, অ্যানটেনার মতো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কাজ শিখছেন। তাঁদের একজন আয়েশা বেগম। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি এটিকে পেশা হিসেবে নিতে চান। প্রশিক্ষণকেন্দ্রটির অধ্যক্ষ বি এম শরিফুল ইসলাম বলেন, অনেক আগ্রহ নিয়েই এ কোর্সটিতে মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
চট্টগ্রামের আরেকটি সরকারি প্রশিক্ষণকেন্দ্র বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এ বছরের প্রথম পর্বে (জানুয়ারি-জুন) ৪২১ জুন নারী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পেশাদারি গাড়ি চালনার।
চট্টগ্রামের আমবাগান এলাকায় বেসরকারি সংস্থা ইউসেপের টেকনিক্যাল স্কুলে পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে নারীরাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই পর্বে ছয় মাস মেয়াদি এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম পর্বে ১১টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২৯০ জন নারী, দ্বিতীয় পর্বে এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ২২৭ জন। তাঁদের মধ্যে কাঠের কাজ, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ইলেকট্রিশিয়ান ও ইলেকট্রনিক অ্যাসেমব্লিং—এই চারটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীর সংখ্যা ৭৬। কারিগরি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চান এই নারীরা।
আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুলে চলতি পর্বে মেশিনে কাঠের আসবাব তৈরির বিষয়ে ২০ জন নারী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মেশিনের পাশাপাশি কীভাবে সনাতনপদ্ধতিতে (হাতে) চেয়ার, টেবিল, খাট কিংবা আলমারি তৈরি করতে হয়, সেই প্রশিক্ষণও তাঁরা পাচ্ছেন। এ বছর প্রথম পর্বে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন আটজন নারী। তাঁদের মধ্যে দুজন সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন কর্ণফুলী ইপিজেডের একটি বিদেশি আসবাব তৈরির কারখানায়। তাঁদের একজন নাজরিন আক্তার বলেন, ‘আপাতত প্রোডাকশন কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছি। তবে সুযোগ পেলে নিজেও আসবাব তৈরি করতে পারব।’
গতানুগতিক ধারার বাইরে কাজ শেখার ক্ষেত্রে নারীদের সবাই যে পরিবারের সমর্থন পাচ্ছেন, তা নয়। অনেকেই পরিবারের অমতে, কেবল নিজের মনোবলের জোরে এসব কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। রেফ্রিজারেটর ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র মেরামতের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, এ রকম দুজন নারী জানান, পরিবারকে বলেছেন বিউটিশিয়ান বিষয়ে তাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে কাজ জুটিয়ে তারপরে বাড়িতে ‘সত্যটা’ জানাবেন।
এ বিষয়ে ইউসেপ বাংলাদেশের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক জয় প্রকাশ বড়ুয়া বলেন, ‘কারিগরি সব বিষয়েই আমরা নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ চাই। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক বাধার কারণে অনেক নারীই পোশাক বা সৌন্দর্যচর্চা-বিষয়ক প্রশিক্ষণের বাইরে যেতে দ্বিধাবোধ করেন। তবে ধীরে হলেও পরিবর্তন হচ্ছে। নারীরা এখন সব ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ নিতে এগিয়ে আসছেন।’