ব্যস্ত নগর জীবনে স্বস্তি : জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন শপিং
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
নতুন বিপ্লবে রূপ নিয়েছে অনলাইন কেনাকাটা। কি পাওয়া যায় না এখানে? বিমান টিকেট থেকে হোটেল বুকিং। জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, কম্পিউটার, মোবাইল থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, জুয়েলারি, শাড়ি, ঘর গোছানোর সামগ্রী সবই কিনতে পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। শুধু কি তাই মাছ, মাংস, কাঁচাবাজারও মিলবে অনলাইন অর্ডারে। আর গত ঈদে তো কুরবানির গরুও মিলেছে। ব্যস্ত নগর জীবনে স্বস্তি এনে দিয়েছে অনলাইন শপিং।
চলতি সপ্তাহেই অনলাইন শপিং নিয়ে কথা হচ্ছিল শেখ ফাহমিদা নামের একন অনলাইন ক্রেতার সঙ্গে। তিনি পেশায় একজন ব্যাংকার। মিরপুর ১১ নম্বরে বাসা। প্রতিদিন সকাল আটটায় অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। অফিস শেষে বাসায় ফেরেন সন্ধ্যা সাতটায়। অফিস সময় আট ঘণ্টা, আর তিন ঘণ্টা কেটে যায় যানজটে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজের পরিবারের দৈনন্দিন কাজ করেন, বাচ্চাকে সময় দেন। ব্যস্ততার কারণে সংসারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে সময় বের করতে পারেন না তিনি। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলেন, ঘরে বসে কীভাবে কেনাকেটা করা যায়। কিন্তু কিছুতেই উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
বাসায় ফিরে কিছুটা সময় ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করা কামরুন নাহারের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বছর খানেক আগে একদিন অনলাইনে ই-শপিংয়ের খোঁজ পান তিনি। প্রথম দিকে শুধু অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পোর্টালগুলোতে ঘোরাঘুরি করতেন। কোন পণ্যের দাম কত, মান কেমন, বিক্রেতা কোন এলাকার, এসব দেখতেন তিনি। মাস ছয়েক আগে একদিন সাহস করে একটি পারফিউম অর্ডার করে ফেললেন। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তার কাছে ওই অনলাইন শপ থেকে ফোন এলো অর্ডার কনফার্ম করার জন্য। তিনি অর্ডার দেয়ার সময় মূল্য পরিশোধের পদ্ধতি ক্যাশ অন ডেলিভারি দিয়েছিলেন। পরদিন দেয়া ঠিকানা মতো তার পছন্দের পারফিউম হাজির। এভাবেই অনলাইনের মাধ্যমে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হলেন ফাহমিদা। এর পর তিনি অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে আরও অনেক কিছুই কিনেছেন। সর্বশেষ গত ঈদ-উল-আযহার সময় অনলাইন শপ থেকেই ওভেন কিনেছেন তিনি।
২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে নিজের অর্ডার করা পণ্য ডেলিভারি পেয়ে ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনলাইন কেনাকাটায়। পণ্য বুঝে পেয়ে মূল্য (ক্যাশ অন ডেলিভারি) পরিশোধের সুযোগে অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেতাদের আগ্রহ আরও বেশি। ইন্টারনেট সহজ করে দিচ্ছে ক্রেতার জীবনাচরণ। অনলাইন শপগুলোর বিক্রেতারা বলছেন ক্রেতাদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন তারা। ফাহমিদা এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, অনলাইন কেনাকাটা আমার জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। একটি জিনিস কিনতে আগে পুরো বিপণিবিতান ঘুরতে হতো। এতে অনেক সময় নষ্ট হতো। এখন সব পাচ্ছি হাতে মুঠোয়। অভিজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে অর্ডার করলে পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার দোরগোড়ায়। অর্থ পরিশোধে পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংক সহায়তাও। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিশোধ করে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় অর্থ। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন। এ কারণে অনলাইন বাজারে কেনাকাটা করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন ক্রেতারা। তারা আরও বলছেন, দোকান বা শপিংমলে গিয়ে যেভাবে পরখ করে পছন্দের পণ্যটি কেনা হয় ঠিক সেভাবে অনলাইন শপে ঢুকে ছবি এবং দাম দেখে অনলাইনেই কেনার অর্ডার দেয়া যায়। ডেলিভারির সময় হাতে অর্ডার দেয়া জিনিস পেয়ে যাচাই করে নেয়ারও সুযোগ রয়েছে। পছন্দসই জিনিস না পেলে অর্ডার বাতিলও করা যায়। অবশ্য তা শুধু ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
অন্যদিকে ক্রেতা-বিক্রেতার এই চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে প্রতিনিয়তই গড়ে উঠেছে অনলাইনে বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমেও চলছে বেচাকেনা চলে। প্রবাসী ক্রেতাদের জন্যও রয়েছে অনলাইনে পণ্য কেনার ব্যবস্থা। এছাড়া রেলওয়ে টিকেট, হোটেল বুকিং এবং অভ্যন্তরীণ বিমানের টিকেট কেনার সুবিধাও দিচ্ছে বেশ কয়েকটি সাইট। বাস ও লঞ্চের টিকেটও পাওয়া যায় অনলাইনে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যার মধ্যে প্রায় ২ শতাংশ বা চার লাখ গ্রাহক নিয়মিত অনলাইনে কেনাবেচা করেন। অনলাইন বাজারে যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়, তেমনি বিভিন্ন উৎসবেও এসব শপে পাওয়া যায় মূল্য ছাড়। অনলাইন বেচাকেনা মূলত হয় দুইভাবে। বিক্রয়ডটকম, এখানে ইডটকমের মতো ওয়েব পোর্টালে বিক্রেতা তার পুরনো পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। আগ্রহী ক্রেতা সেই বিজ্ঞাপন দেখে ওই বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে দুজনের আপসের ভিত্তিতে পণ্যটি বেচাকেনা হয়। এজন্য অবশ্য নগদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এসব ওয়েবসাইটে এখন নতুন পণ্যের বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেয়া শুরু হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাঁর নিজস্ব পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আবার বেশ কিছু ওয়েব পোর্টাল রয়েছে, যারা নিজেরাই পণ্য বিক্রি ও সরবরাহ করে। ক্রেতা শুধু পণ্য পছন্দ করে অনলাইনে কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করেন। এসব পোর্টালে মোবাইল ব্যাংকিং ও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে বিল পরিশোধেরও সুবিধা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আজকের ডিল, কাইমু ডটকম, চালডাল ডটকম অন্যতম। বাংলাদেশের ভোক্তা আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশীরা কী ধরনের ওয়েব পোর্টালে যেতে পছন্দ করেন, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় গুগল ট্রেন্ডসের ২০১৩ সালের হিসেবে। সেখানে দেখানো হয়েছে, গুগল সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে এসএসসির ফলাফলের ওয়েবসাইটে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশীরা। পরের স্থান রয়েছে এইচএসসি ফলাফলের ওয়েবসাইট। আর গুগল দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রবেশ করেছেন তৃতীয় সর্বাধিক ব্যক্তি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চতুর্থ স্থানটি দখল করে আছে অনলাইন বেচাকেনার ওয়েব পোর্টাল বিক্রয়ডটকম। এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফল জানতে বছরে এক দিনই সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা হয়। নিয়মিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিবেচনা আনলে ফেসবুকের পরেই বেচাকেনার ওয়েবপোর্টালে প্রবেশ করেন বাংলাদেশীরা।
সেলবাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালে প্রথম অনলাইনে বেচাকেনা শুরু করে। এরপরই অনলাইন বেচাকেনার প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে এমন প্রায় শতাধিক ওয়েবপোর্টাল রয়েছে। এ পোর্টালগুলো ব্যবসায়িকভাবে বেশ সফল হতে শুরু করেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ এসব পোর্টাল দেখছে, এমন বিবেচনায় এখানে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা করছেন অনেকে। ফেসবুক ও ওয়েবপোর্টাল মিলিয়ে অনলাইনে অর্ডার করলেই পণ্য সরবরাহ করছে সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশে অনলাইনে বেচাকেনার সবচেয়ে বড় ওয়েব পোর্টাল হলো বিক্রয় ডটকম। ২০১২ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করে এ খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এটি। জানা গেছে, শুরুতে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার ক্রেতা পণ্য কিনতে এই ওয়েব পোর্টালে প্রবেশ করতেন। এখন প্রতি মাসে গড়ে ২০ লাখ আগ্রহী ক্রেতা নিয়মিতভাবে এই ওয়েব পোর্টালে যান। পোর্টালটিতে বর্তমানে তিন লাখের বেশি পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার বিজ্ঞাপন পায় বিক্রয়ডটকম। বিজ্ঞাপন দিতে কোন টাকা লাগে না। শুধু পণ্যের ছবি, দাম, বিক্রেতার যোগাযোগ নম্বর ও ঠিকানা দিতে হয়। বিক্রয়ডটকমে প্রতিটি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে চার-পাঁচটি ফোনকল পান বিক্রেতা। অনেক সময় বিজ্ঞাপন দেয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। এ বিষয়ে বিক্রয়ডটকমের বিপণন ব্যবস্থাপক ইশিতা শারমীন বলেন, অনলাইনে বেচাকেনা মানুষের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন করছে। আগে পুরনো জিনিস ফেলে দেয়া হতো কিংবা কাউকে উপহার দেয়া হতো। এখন পুরনো জিনিস বিক্রি করে সেই টাকা নতুন জিনিস কেনায় কাজে লাগানো হচ্ছে। আজকের ডিল ডটকম এর হেড অব অপারেশন দেবাশীষ ফণী জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১১ থেকে আজকের ডিল ডটকম যাত্রা শুরু করে। তিনি বলেন, শুরুর দিকে প্রতিদিন একটি পণ্যও আমরা বিক্রি করতে পারতাম না। তবে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০টি পণ্য আমরা বিক্রি করতে পারছি। তিনি বলেন, আসলে আমরা যে সময় যাত্রা শুরু করি, তখন আমাদের দেশে ইন্টারনেট সেবাও খুব দুর্বল ছিল। একই সঙ্গে দেশের মানুষ ওই সময় অনলাইন কেনাকাটায় খুব একটা পরিচিতও ছিল না।
তিনি আরও বলেন, থ্রিজি ইন্টারনেট সেবা চালুর পর থেকেই অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। দেশে যে কটি অনলাইন শপ রয়েছে তাদের মধ্যে আমরাই প্রথম বাংলায় ওয়েব পোর্টাল করেছি। দেশের সকল মানুষের দোরগোড়ায় এ সেবা পৌঁছে দিতেই আমাদের এ উদ্যোগ।
দেবাশীষ বলেন, আমাদের ওয়েবসাইটে যারা ভিজিট করেন, তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অর্ডার আমরা পাই। বাকিরা অর্ডার করেন না। ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ ভিজিটরের পণ্য না কেনার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এদের মধ্যে অনেকের পণ্যটি প্রয়োজন হয় না, আবার অনেকে এখনও অনলাইনে কেনাকাটার সঙ্গে পরিচিত নন। দেশের মানুষ অচিরেই অনলাইনে কেনাকাটা করতে নির্ভরশীল হয়ে উঠবে বলে আশা দেবাশীষের।