সময় ব্যবস্থাপনা বদলে দিতে পারে আপনার জীবন

সময় ব্যবস্থাপনা বদলে দিতে পারে আপনার জীবন

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক 

সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সময় ব্যবস্থাপনা। আপনাকে অবশ্যই সময় ব্যবস্থাপনা জানতে হবে। সময় ব্যবস্থাপনা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, যদি আপনি সঠিকভাবে তা প্রয়োগ করতে পারেন। টাইম ম্যানেজমেন্ট বা প্রায়োরিটি ম্যানেজমেন্ট অনুযায়ী প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আপনার প্রতিদিনের কাজগুলো লিপিবদ্ধ করুন, প্রতিটি কাজে এখন আপনি গড়ে কত সময় ব্যয় করছেন তা নিরূপণ/ ঠিক করুন, প্রতিটি কাজে গড়ে কতটুকু সময় প্রয়োজন তা বের করুন, প্রতিটি কাজে গড়ে আপনি কতটুকু সময় অতিরিক্ত ব্যয় করেন তা বের করুন, এখন সিদ্ধান্ত নিন কীভাবে আপনি আপনার সময় ব্যয় করবেন? আপনার হাতের অতিরিক্ত সময় অন্য কোন প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করুন। “সময়কে ঠিকমতো গুছিয়ে নিতে পারলে, আপনার দ্বারা সবই সম্ভব!”


সময় ব্যবস্থাপনা 
সময় ব্যবস্থাপনার মধ্যে দুইটি শব্দ রয়েছে । একটি হলো সময় অপরটি হলো ব্যবস্থাপন । সময় হলো সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, সপ্তাহ, মাস ও বছর । আর ব্যবস্থাপনা হলো চালিকাশক্তি যা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যাবলি অর্জনে সাহায্য করে ।

সময় ব্যবস্থাপনা হলো প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের জন্য সময়কে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা। সময় ব্যবস্থাপনা হলো সময়ের সদ¦ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানো। সময় ব্যবস্থাপনা হলো নিজকে এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে আমরা যে সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ সেই সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি। সময় ব্যবস্থাপনা হলো হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক সময়ের যথাযথ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। সময় ব্যবস্থাপনা হলো ব্যক্তি জীবন ও সামষ্টিক জীবনে যথাসময়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। এক কথায় বলতে গেলে ব্যক্তি জীবন, সামষ্টিক জীবন ও প্রতিষ্ঠানের স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের জন্য পরিকল্পিতভাবে সময়ে কার্যকর ও বাস্তবমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে অল্প সময়ে অধিক কাজ করে লাভবান হওয়া।

সময় ও কারােত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময় একবার চলে গেলে তা আর ফিরে আসেনা। তাই জীবনের যে কোনো পর্যায়ে সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের যেমন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থাকে, সামষ্টিক জীবনেও তেমনি থাকে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। যথাসময়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়। এর জন্য চাই সময়ের কার্যকর ও বাস্তবমুখী ব্যবস্থাপনা। চাই কর্মমুখর জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলা। বস্তুত, সফল জীবনের নেপথ্যে রয়েছে একটি সুশৃঙ্খল সুষ্ঠু ও সুষম সময় ব্যবস্থাপনা।

মানুষের জীবনের কিছু চাওয়া থাকে, কিছু লক্ষ্য থাকে। এগুলো নির্ধারণ করে দেয় পরিবেশ, প্রয়োজন ও বাস্তবতা। লক্ষ্যগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজানো সময় ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক কাজ । সেই অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছতে পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় । Good Planning half done work একটি ভালো পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক সমাধান করে দেয়। সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে কাজগুলো সেরে নিতে হয়। তার জন্য চাই পরিপূর্ণ মনোযোগ ও একাগ্রতা।

তবে সময় ব্যবস্থাপনার ধরনটি ব্যক্তি ও পরিবেশভেদে ভিন্ন। পেশাগত ভিন্নতার কারণেও এর ধরণ ভিন্ন হতে বাধ্য । এমনকি, শ্রেণীগত অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পার্থক্যের কারণে একেকজনের সময় ব্যবস্থাপনার ধরন একেক রকম। ভিন্ন-ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাংস্কৃতিক কারণেও তা আলাদা হয়। আর্থসামাজিক কাঠামো-পরিকাঠামোভেদেও এটি ভিন্ন হয়ে থাকে।

সময়-ব্যবস্থাপনা এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা সবাই অনেক কথা শুনে থাকি। যথাযথ সময় ব্যবস্থাপনার জন্য মাঝে মাঝে মানুষের কাছে অনেক বকুনিও শুনতে হয় আমাদের। কিন্তু সময় ব্যবস্থাপনার কার্যকর কোনো পদ্ধতি নিয়ে খুব একটা শোনা যায় না! কীভাবে সময়-ব্যবস্থাপনা করা যায় তা বুঝতে হলে, প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে সময় ব্যবস্থাপনা বিষয়টা আসলে কী। সময় ব্যবস্থাপনা আসলে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো বিষয় নয়। কেননা ব্যবহারিক অর্থে, যার উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই, আপনি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না! (আপনি কি সময়ে ধরে রাখতে কিংবা দ্রুত পার করতে পারেন?!) তা কোনটাই সম্ভব নয় বরং আপনি সময়কে সঠিক ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন।

সময় ব্যবস্থাপনার তিনটি ধাপ
১.আপনার সময়ের বিশ্লেষণ করুন।
২.নিষ্ফল বা নিরর্থক চাহিদাগুলো ছাঁটাই করুন।
৩.হাতে সময় নিয়ে আপনার কাজগুলো সম্পন্ন করার লক্ষ্য স্থির করুন।
আসুন প্রাত্যহিক জীবনরীতির আলোকে উপরোক্ত ধাপ তিনটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাক।
১.আপনার সময়ের বিশ্লেষণ করুন : কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় নিয়ে নিজের সময়কে লিপিবদ্ধ করুন। আমি এখানে সত্য কথাটাই বলব, এক সপ্তাহে আপনি কত সময় অপচয় করেন তা উপলব্ধি করার জন্য বুকে সাহস থাকা চাই। তবে নিজের সাথে সত্যবাদীর মতো আচরণ করাটাই হলো প্রতিকারের প্রথম পদক্ষেপ। সময় লিপিবদ্ধ করার দুই ধরণের পদ্ধতি আছে :
ক.সাথে একটি ডায়েরী রাখুন এবং প্রতি ঘন্টায় কী কী করলেন, তা লিখে রাখুন।
খ.যখন আপনার সময় বিশ্লেষণ করবেন, তখন আপনার বন্ধু/প্রতিবেশী/স্বামী বা স্ত্রীকে সাক্ষী রাখুন। (কারণ আমরা যখন সময় লিপিবদ্ধ করি, তখন সততার সাথেই তা করি। কিন্তু শেষে গিয়ে নিজেই নিজেকে ধোঁকা দিয়ে বসি।)
২.নিষ্ফল বা নিরর্থক চাহিদাগুলো ছাঁটাই করুন : আশা করছি, সময় বিশ্লেষণের পর একটা দু:খবোধ আপনাকে পেয়ে বসবে! ভাববেন, আমরা এমন অনেক কিছুই করি যা একেবারেই ঝেড়ে ফেলা যায়। আপনার এখন মনে হবে : সকালবেলা কফি খাওয়ার অজুহাতে ক্যাফেতে বসে একঘণ্টা সময় বৃথা নষ্ট না করে বাড়িতেই কফি বানিয়ে খাওয়া যেতো না? কফি খেতে খেতে ই-মেইলগুলোও কি পড়া যেতো না? টিভির চ্যানেল হাতড়ে বা ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রতিদিন দুই ঘন্টা সময় ব্যয় করা কি আমাদের জন্য সত্যিই জরুরি? আমরা কি এসব থেকে সময় বাঁচাতে পারি না? (সাবধান! আল্লাহর জন্য বরাদ্দ সময় বাঁচাতে যাবেন না! “সময় বাঁচানোর” নামে কিছু লোক মসজিদে সালাত আদায় করতে যায় না। এই রকম সময় বাঁচানো নিষ্ফল কর্ম। মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। অতএব, সময় বাঁচানোর নামে দ্বীনের কাজের সময় কমাতে যাবেন না। দ্বীনের জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় না করার দায়ে আমরা ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত। তাই পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে আমরা যেন সময় বাঁচানোর অজুহাতকে ক্ষেত্রে ব্যবহার না করি।)

৩.হাতে সময় নিয়ে আপনার কাজগুলো সম্পন্ন করার লক্ষ্য স্থির করুন : যখন আপনি কঠিন কিছু নিয়ে কাজ করছেন এবং পুরোপুরি কাজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে আছেন, ঠিক তখনই একটা ফোন কল বা ই-মেইল কিংবা মেসেজ এলার্ট কি বিরক্তিকর নয়?! এই তৃতীয় ধাপ বা কৌশলটিতে মূলত যা বলা হচ্ছে তা হলো, আপনাকে সময় ভাগ করে নিতে হবে এবং তা করতে হবে আপনার জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সময় খন্ডে (অনেকের মতে, এক নাগাড়ে সর্বোচ্চ ৯০ মিনিট মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব। তবে এই ৯০ মিনিট হতে হবে বিরতিহীন)। সামান্য পরিমাণ কাজ করে সর্বোচ্চ পরিমাণ সুফল পেতে এই পদ্ধতি সহায়তা করবে। কারণটা খুব সহজ। আর তা হলো, আপনি এভাবে কাজ করলে একটি কাজের প্রতি আপনার সবটুকু মনোযোগ কাজে লাগে নিবিড়ভাবে এবং নির্বিঘেœ। এক ঘন্টার একটি কাজ করতে আপনার ৪ ঘণ্টা লেগে যাবে যদি প্রতি ১০-১৫ মিনিটে আপনি বিরতি নেন বা বাধাপ্রাপ্ত হন।

সময় ব্যবস্থাপনার উদ্দেশে
সময় ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হলো তথ্য প্রযুক্তির কলা-কৌশলের মাধ্যমে প্রাপ্ত সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিকল্পনা অনুযায়ী অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানো। সময় ব্যবস্থাপনার অনেক রীতি, কৌশল, পদ্ধতি ও প্রযুুক্তি বিকশিত হয়েছে। এক সময় হয়তো মানুষ তার করণীয় টুকে রাখতো পাথরের দেয়ালে। তারপর কর্তব্যগুলো আরও সাজিয়ে, সুসংগঠিতভাবে পালনের জন্য তৈরি করেছিল ডায়েরী, নোটবুক। তৈরি করেছিল পঞ্জিকা। এতে তাদের চোখের সামনে পরিকল্পনাগুলো ঝুলিয়ে রাখার রীতি চালু করেছিল। আজকের দিনে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার মানুষের নিত্যসঙ্গী। সেই সঙ্গে এগুলো মানুষের সময় ব্যবস্থাপনাকে আগের তুলনায় যথেষ্ট সহজ করে তুলেছে। ব্যক্তিগত সময় ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি মোবাইল সেটেই অপশন রয়েছে। কম্পিউটারেও রয়েছে অনেক সফটওয়্যার। এগুলো দিয়ে মানুষ তার লক্ষ্য ও দায়িত্বকে সুসংবদ্ধ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাজাতে পারে আরও সহজে। একই সঙ্গে এসব অগ্রাধিকার লিপিবদ্ধ করে তার অগ্রগতিকে শনাক্ত করতে পারে অনায়াসে। যতো দিন যাচ্ছে, মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ ততোই বাড়ছে। বাড়ছে কর্মব্যস্ততাও। এই মাল্টিটাস্কিংয়ের যুগে নানা তথ্য মনে রেখে চলা কঠিন। লিখতে শেখা থেকে শুরু করে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন স্নায়ুর চাপ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। যে যতো সংগঠিতভাবে এসব পদ্ধতির ব্যবহার করতে পারে, তার জন্য কাজ ততো সহজ হয়ে যায়।

আধুনিক কালে সময় ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের শাখা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। বড়-বড় সংগঠন, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেই জ্ঞান ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও কাজে লাগছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বা শিল্প-প্রতিষ্ঠানে যেকোনো বিষয়ের সঙ্গেই যুক্ত থাকে সময়সীমার প্রসঙ্গ, তেমনি ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে প্রতিটি বিশেষায়িত শ্রমের জীবনেও তা থাকছে। এ সংক্রান্ত জ্ঞান তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। আমরা জানি, সময়ের সঠিক ব্যবহার এক ধরনের সচেতনতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞানও বটে। যে মানুষকে সকাল-সকাল অফিসে দৌড়াতে হয়, তার জন্য রাত জেগে থাকা যেমন উচিত নয়, আবার যিনি রাতভর কোনো সংবাদমাধ্যম সামলাবেন, দিনভর দাপিয়ে বেড়ানোও চলে না তাঁর।

জীবনের তাগিদে মানুষ কাজ করে, বিশ্রাম নেয়। উপার্জনের অর্থ দিয়ে মানুষ বিশ্রাম কেনে। কাজের পাশাপাশি বিশ্রামের জন্য কীভাবে সময় বণ্টন করা হবে, তাও সময় ব্যবস্থাপনার একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয়। একটি সুষম ব্যক্তিগত সময় ব্যবস্থাপনার মধ্যে প্রয়োজনীয় বিশ্রামের প্রসঙ্গও গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর না পড়ে শুধু পরীক্ষার আগের রাতে এর সদ্ব্যবহার করতে চাইলে পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ার শঙ্কাই বেশি। অসময়ে জমিতে বীজ বুনে লাভ নেই। কারণ, সময় গেলে সাধন হয় না।

বাংলাদেশের মতো অশিল্পায়িত দেশে এখনো কৃষিই মানুষের প্রধান উপজীবিকা। এখন অবশ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ওপর চলছেন অনেকেই। সেই অর্থে বিশেষায়িত শ্রমের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে বহু লোক কাজের খোঁজে শহরের দিকে ছোটে। ফলে নগরে জনস্ফীতির চাপ পড়ে। অপ্রতুল অবকাঠামোর ওপর এই চাপ তীব্র যানজটের মতো সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই শহরগুলোতে সার্বিকভাবে বড় ধরনের অপচয় হয় সময়ের। এছাড়া নানা ধরনের সেবার অপ্রতুলতার কারণেও এমনটি হয়। এগুলো এক-দুই দিনে সমাধানযোগ্য সমস্যা নয়। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই সময় ব্যবস্থাপনার রূপরেখা তৈরি করতে হয়। যেমন, একবার বিদ্যুৎবিভ্রাট হলে যদি ঘণ্টা খানেক অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা রাখাই সবচেয়ে কার্যকর সময় ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত। কাজের পাশাপাশি নিজেকে সমৃদ্ধ করা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিম-লের সঙ্গে যুক্ত রাখতে সময় বের করে রাখা দরকার। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে নানা ধরনের অভ্যেস বা সম্পৃক্ততার কারণে আমাদের অনেকেই নেতিবাচক আসক্তিতে জড়িয়ে রয়েছেন। যেকোনো আসক্তি মানুষকে তার বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে কারণেই এসব থেকে নিজেকে যতোটা দূরে সরিয়ে রাখা যায়, ততোই মঙ্গল। সঙ্গ, সম্পর্ক ও সম্পৃক্ততার মানসিক অভিঘাত অনেক সময় কেড়ে নেয় মূল্যবান সময়, যেসব এড়িয়ে চলতে পারলে জীবনকে যথেষ্ট সহজ ও সুন্দর করে তোলা সম্ভব। বিশেষ ঝোঁক বা দুর্বলতাও ছিনিয়ে নেয় সময়। এগুলো কাটিয়ে ওঠাও সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দিক। কাজের বোঝা জমিয়ে রাখা মোটেও উচিত নয়। বিশ্রাম বা অবকাশের জন্য নির্ধারিত সময় থেকে যদি কাজের সময়কে ধার দিতে হয়, তবে তার মাশুল গুণতে হয় শরীরকে, যার অনিবার্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতার ওপরও। সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে মানসিক স্থিরতা অত্যন্ত জরুরি। এক কাজের মধ্যে আরেক কাজ না করাই ভালো। তালগোল পাকানো কাজ যেমন ভালো হয় না, তেমনি সময় নষ্টের কারণও ঘটায়। জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানগুলো পথ দেখায়। ফলে শিক্ষা, সংসার, সন্তান ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর সময় নির্ধারণে তাদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব
সময় ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনামাফিক এর সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কে ছোটবেলাতেই আমাদের শেখানো হয়। কিন্তু এটি ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অনুধাবন করতে পারি না। সময় ব্যবস্থাপনা হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক সময়ের যথাযথ ব্যবহার। আর এ বিষয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা কর্মস্থলে অবশ্যই মেনে চলতে হয়। কিন্তু শুধু এক্ষেত্রেই নয়, জীবনের পথ চলার অনেক ক্ষেত্রে সময় ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। এ ব্যবস্থাপনা আপাতদৃষ্টিতে মেনে চলা খুব সহজ মনে হলেও আসলে তা নয়। সুষ্ঠু সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আপনি আরো বেশি কাজ সাফল্যের সঙ্গে শেষ করতে পারবেন। যদি আপনি কর্মস্থলে সময় ব্যবস্থাপনার ব্যবহার করতে পারেন তাহলে আপনার সময় তো বাঁচবেই, আপনি খুব অল্প সময়ে গুণগত মানসম্পন্ন কাজও করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, এতে আপনার কাজের উৎকর্ষও বাড়বে। ফলে আপনার ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। অন্যদিকে সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা না জানলে শুধু কর্মক্ষেত্র নয়, আপনার পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনেও যে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের জীবনে সময়জ্ঞান জরুরি। সময়মতো মিটিং, ক্লাস, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতে উপস্থিত হতে না পারলে শ্রমের ফলপ্রসূতা কমে যায়। যানজটের দেশ, তার ওপর দুর্ঘটনা, ঝুঁকি-ঝামেলার অন্ত নেই। তাই অনাহূত বিপদে বিলম্ব হতে পারে, সে হিসাব পথে নামার আগেই থাকতে হবে। সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক অনুধাবন জরুরি। তাই পড়াশোনা বাড়াতে হবে। যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ্য থাকতে হবে। ব্যক্তির সময়-চেতনার ওপর ভিত্তি করেই গোটা সমাজের সময়-সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নিয়মানুবর্তিতার বিষয়গুলো নিয়ে ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো-পড়ানো হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা সবাই তা পালন করি না। আমাদের জাগ্রত দশার প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর ওপর ব্যক্তিগত উন্নতি যেমন নির্ভর করে, তেমনি মানুষের সার্বিক বিকাশেও এর প্রভাব পড়ে। তাই প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানো উচিত। ধরুন, আপনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে বসে আছেন। আর গাড়ি আটকা পড়েছে জ্যামে। এই ফাঁকেও নিজের টুকিটাকি কাজগুলো সেরে নেয়া যেতে পারে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা ব্যবসায়িকভাবে প্রয়োজনীয় ফোনগুলো করতে পারেন এ-সময়। অথবা কাজের চাপে, ক্লান্ত হয়ে থাকলে এই ফাঁকে রিল্যাক্স করুন। চোখ বন্ধ করে ফেলুন। হেডফোন লাগিয়ে দু-চারটা পছন্দের গান শুনতে পারেন। কাজগুলো যতো সুশৃঙ্খলভাবে করা যাবে, ততোই সময় বাঁচবে। সে সময় দিতে পারবেন নিজেকে, নিজের পরিবারকে। অহেতুক ছুটি কাটিয়ে বসে থাকলে জরুরি সময়ে ছুটি মিলবে না। এখন ইন্টারনেট-নির্ভরতা বেড়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মানুষ অনেক সময় দিচ্ছে। অনেকেরই তা আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মন:সংযোগ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসবে সময়ক্ষেপণ কমিয়ে আনা সম্ভব। অনেকেই নি:সঙ্গতায় ভোগেন। ফেসবুক, টিভি সিরিয়াল, দীর্ঘক্ষণ মোবাইলে কথা বলা ইত্যাদি তাদের জন্য সময় কাটানোর মাধ্যম।

সময়ের গন্ডিতে বাঁধা আমাদের জীবন, চলমান সময়ের প্রত্যেক সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সফল জীবন রচনায় প্রয়োজন সঠিক সময় ব্যবস্থাপনার। জীবনকে অর্থবহ, সমৃদ্ধ ও সুখস্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সময় সচেতন ও পরিকল্পিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া। আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সময়ের কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি সূরা আল আসরে বলেছেন : ‘সময়ের কসম। মানুষ আসলে বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে, একজন অন্যজনকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দিয়েছে।’

সময় হচ্ছে এমন একটি সম্পদ যা একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। স্মরণ রাখতে হবে, আমরা অনেক কিছুই করতে পারব, কিন্তু সময়কে টেনে লম্বা করতে পারব না। যারা কাজের মধ্য দিয়ে সময় কাটায়, তারা সর্বদা আনন্দের মধ্যে থাকে। যারা অলস বসে থাকে তারা নানা দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার শিকার হয়। সময় এমন একটি বন্ধু, যা নিমেষে নিমেষে রূপ বদলায় এবং চমৎকার সব উপহার-উপঢৌকন তুলে দেয় আমাদের হাতে। আর যদি আমরা তাকে অবজ্ঞা করি তাহলে সে যাবতীয় উপহার-উপঢৌকনসহ চুপিসারে চলে যায় আমাদের কাছ থেকে। আমাদের দেশে সময়ের অপব্যবহার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আমরা যদি সময়ানুবর্তী না হই দেশ আগাবে না, সময় নষ্ট করা জাতীয় কৃষ্টি হিসেবে গড়ে উঠবে।
আমরা যদি সময়কে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি তাহলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে জ্ঞানচর্চা, দেশসেবা, সমাজসেবা, মানবতার জন্য, নিজের ধর্ম ও আদর্শের জন্য কাজ করা। আর রাষ্ট্রেরও সময় ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সুধী পাঠকদের হংকংয়ের একটি রাষ্ট্রীয় সময় ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত দিতে চাই, তা হলোÑহংকং একটি সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে দেখল যে যদি পাহাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তা নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে পাঁচ সেকেন্ড সময় বেশি লাগবে আর যদি পাহাড় কেটে ভেতর দিয়ে রাস্তা নেয়া হয় তাহলে পাঁচ সেকেন্ড সময় কম লাগবে। কিন্তু পাহাড় কেটে রাস্তা করতে রাষ্ট্রের ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকা। হংকং রাষ্ট্রীয় পাঁচ সেকেন্ড সময় বাঁচানোর জন্য ১০০ কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু সময় ব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে, মেধা ও জাতীয় জীবনে সময়ের গুরুত্ব কম দেই বলেই আজো আমরা দরিদ্র ও অনুন্নত জাতি। আমরা অনেক সময় দেখতে পাই উচ্চপদের কর্মকর্তা, এমনকি সাধারণ কর্মী প্রায় ১ ঘণ্টা দেরিতে অনুষ্ঠানে বা কর্মস্থলে পৌঁছে। সময় ব্যবস্থাপনার জ্ঞান, কৌশল সচেতনতা সৃষ্টি হলে অবশ্যই আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জন দ্রুততর হবে।

তাই সবাইকে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা অর্জন করে পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি সাফল্য থেকেই ধাপে ধাপে পরিবার, সমাজ ও দেশের সাফল্য নিশ্চিত হবে। আমরা সময় বাঁচাতে পারি টিভি কম দেখে, নাটকের সিরিয়াল কম দেখে, মোবাইলের ব্যবহার কমিয়েও আড্ডায় সময় কম দিয়ে। আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণী, গৃহিণী ও ছাত্রছাত্রীদের সময় অনেক বেশি নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি অভিভাবকদেরও ভেবে দেখতে হবে। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিবস, মাস আর বছরের সমষ্টি হচ্ছে আমাদের জীবন। এই জীবনকে আলোকিত করতে সময়ের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। চার্লস ডিকেন্স বলেন, ‘বড় হতে হলে সর্বপ্রথম সময়ের মূল্য দিতে হবে।’

সুতরাং আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে হিসাব করে কাজে লাগাতে হবে। আর এ জন্য চাই একটি পরিকল্পিত রুটিন আর গোছালো জীবন। কিন্তু তা কখন থেকে? অবশ্যই এখন থেকে। কেননা প্রবাদ আছে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় । আর জীবনে বড় কিছু করতে হলে তা শুরু করতে হবে উপযুক্ত সময়ে । কারণ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজ সংস্কারে হিলফুল ফুজুল গড়ে তুলে ছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। আইনস্টাইন ১৬ বছর বয়সেই আপেক্ষিক মতবাদ নিয়ে প্রথম চিন্তা করেন, যা পরবর্তীকালে ২৬ বছর বয়সে প্রমাণ করেন।

সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো
সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে সফলতা আসবেই। সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর উপায়গুলো নিম্নরূপ:
১.সময় হত্যা থেকে বিরত থাকা : সময়কে কোন কাজে না লাগানোর অর্থই হচ্ছে সময় হত্যা করা। চাই সে সময় যত অল্পই হোক না কেন। এভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত কি পরিমান সময়কে আমরা হত্যা করি, একদিনের হিসেব টানলেই দেখবেন বুঝমান ব্যক্তি মাত্রই মাথা ঘুরপাক খেতে বাধ্য হবে। ঘুম থেকে উঠার পর বিছানা থেকেই শুরু হয় রক্তারক্তির। বিছানায় বসেই হত্যা করে ফেলি বেশ কিছু সময়কে। ফজরের সালাতের পূর্বে নিজের অজান্তেই হত্যা হয়ে যায় অসংখ্য সময়। এভাবেই চলতে থাকে প্রতিটি দিন-রাত, সারাটা মাস, বছর এবং সারাটা জীবন। কাজেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে রাত দিনে আমি একটি সেকেন্ডকেও হত্যা করব না, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথ কাজে লাগাব, অপচয় হতে দিবনা। মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন: অর্থাৎ-মানুষ সাধনা করে সবই অর্জন করতে পারে। (নাজম : ৩৯) কাজেই আমরা চেষ্টা করলে সময় অপচয়ের বিশাল ক্ষতি থেকে আমরা অবশ্যই বাঁচতে পারব ইনশা’আল্লাহ।

২.সময় ব্যয়ের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ : আপনি সময়কে অপচয় করলেন না ঠিকই কিন্তু এক ঘন্টার কাজ ২ ঘন্টায় করলেন। কারণ আপনার সময় ব্যয় করার স্বাধীনতা আছে। না, এটা করা যাবে না। এ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দায়িত্বশীলের কাজের গতি হতে হবে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। একঘন্টা সময়ে আপনি কত বেশি কাজ করতে পারেন সে চেষ্টা করতে হবে। সমুদ্রে ওযু করতে বসেছি বলে ইচ্ছে মত পানি ব্যবহার করা যাবে না, ইসলাম এটাকে মাকরুহ বলেছে। এভাবে প্রতিদিন ১ ঘন্টা করে সময় হেফাজত করে কাজ বাড়ালে বছরে ৩৬৫ ঘন্টা সময়ের কাজ বেশি হবে।
৩.কাজের অগ্রাধিকার তালিকা করা : কাজের অগ্রাধিকার তালিকা না থাকলে আপনি ইচ্ছামত কাজ করতে পারেন। ফলে দিনের শেষে ধরা পড়বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ থেকে গেছে আর কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হয়েছে। কাজের অগ্রাধিকার তালিকা করা থাকলে কোন কাজ যদি বাদ দিতে হয়, তো কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দেয়া সম্ভব হবে। কর্মব্যস্ত দায়িত্বশীলকে এটি দারুণভাবে সহযোগিতা করবে।

৪.দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করতে হবে : কোন কাজ কোন সময় করবেন? কোনটা করবেন, কোনটা করবেন না? এ নিয়ে অনেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন যা মোটেই ঠিক না। এ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে অযথা অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। কারো কারো এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে মধ্যে পুরো দিনটাই কেটে যায় কোন কাজ আর করা হয় না। এটি খুবই নিন্দনীয় স্বভাব। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে নির্বিঘেœ কাজ করে যেতে হবে। কাজের তালিকা পূর্বের দিন করে রাখলে এ

সমস্যায় আর পড়তে হবে না।

৫.সময়ে সঠিক কাজ করা : ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই হল যখন যে কাজ তখন সেটি করা। সালাতের সময় হয়েছে তো সালাত আদায় করে নেয়াটাই তখন কর্তব্য। যখন যে কাজের সময় তখন তা না করে অন্য কাজ করলে তাতে যথাযথ মনোনিবেশ থাকেনা। ফলে কাজে ভুল, অসুন্দর ও বিলম্বিত হয়। অন্য সময়ে করতে গেলে উপায়-উপকরণ এবং সহযোগীতা না পাওয়ায় প্রচুর সময় অপচয় হয়।

এছাড়াও অনেক সময় একটি কাজ করতে গেলে অন্য আরো পাঁচটি কাজ তখন এসে ভিড় জমাতে পারে। সেক্ষেত্রে আগ্রহ সামলিয়ে সে কাজগুলো যথাসময়ে করার জন্য রেখে দিয়ে পূর্ব পরিকল্পিত কাজটি করে নেয়াটাই উচিত। তবে অতীব জরুরী কাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা ।

৬.কাজের সময়সূচি সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট হওয়া : প্রতিটি কাজের সময়সূচি লিখিত ভাবে থাকাটাই উত্তম। পড়া কিংবা কাজটি শুরু কয়টায়? শেষ কয়টায়? সব লিখা থাকতে হবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেন কাজটি অবশ্যই শেষ করা যায়।

৭.শেষ সময়ের জন্য কাজ রেখে না দেওয়া : একেবারে প্রান্তিক সময়ে কোন কাজ করার জন্য রেখে দেয়া ঠিক নয়। কারণ: তখন কাজটি করার সুযোগ নাও পাওয়া যেতে পারে। এর চেয়ে অতীব জরুরী কাজের ব্যস্ততা এসে যেতে পারে। আবার সময় পাওয়া গেলেও তাড়াহুড়ার কারণে নানা ধরণের ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। যেমন ধরুন; আপনি সফরে যাবেন। ৩টায় ট্রেন ছাড়ার সময়। আপনার পরিকল্পনা হল : ব্যাগ গোছাবেন ২.৩০-২.৪৫ পর্যন্ত। ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন ২.৪৫ মিনিটে। এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করলে এটা খুবই সম্ভাবনা থেকে যাবে যে আপনি তাড়াহুড়া করে ব্যাগ গোছাতে গিয়ে নিজের পায়জামার পরিবর্তে ছোট বোনের পায়জামাটাই হয়তো আপনার ব্যাগে অনায়াসে ঢুকিয়ে নিতে পারেন। যা আপনাকে পরবর্তীতে চরম ভোগান্তিতে ফেলে দিতে পারে। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং ইসলাম শিখিয়েছে, এমন সময়ে ফজরের সালাত আদায় কর যেন কোনক্রমে সালাত ভঙ্গ হয়ে গেলে সূর্যোদয়ের পূর্বে পুনরায় যেন যথাযথভাবে আবারও সালাত আদায় করে নেয়া যায়। অতএব, প্রান্তিক সময়ের জন্য কাজ হাতে না রেখে এখনই করে নেয়া উত্তম।

৮.একসাথে অনেক কাজ করার চেষ্টা করা : দায়িত্বশীল ঢিলেঢালা কিংবা অকর্মা হতে পারে না। তাকে অবশ্যই অনেক কাজ করতে হবে। এক কাজের দোহাই দিয়ে অন্য কাজকে পিছে ফেলে রাখা বা না করা, আর যেই হোক দায়িত্বশীল এমন করতে পারেনা। কাজেই এক সাথে অনেক কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। গাড়িতে বসে প্রয়োজনীয় ফোন করার কাজটা সেরে নেয়া যেতে পারে। ক্লাসে স্যার আসতে দেরী হচ্ছে কিংবা আসবেন না, এই সুযোগে প্রয়োজনীয় লেখাটা বা নোটটা লিখে নেয়া যায়। একই সাথে নিজে কাজ করা, অন্যান্য দায়িত্বশীলদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া ও বাকিদের তদারকী করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল
১ টেলিফোনে উপস্থিতি নিশ্চিত করা : কারো সাথে দেখা করতে যেতে চাইলে আগে টেলিফোনে কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে তবে যেতে হবে। কারণ তাকে না পেলে আপনার সময়টা অপচয় হবে।
২.কাগজ কলম নোট বুক সাথে রাখা : সব সময় কাগজ কলম বা ছোট নোট বুক সাথে রাখবেন। কোন কাজের তালিকা মনে হওয়া মাত্রই যেন লিখে নেয়া যায়।
৩.সম্ভাব্য সময় হাতে রেখে রওয়ানা হওয়া : দূরে যেতে হলে সম্ভাব্য সময়ের চেয়ে বেশি সময় হাতে রাখবেন। কারণ পথে জ্যাম কিংবা অনাকাংখিত কিছু ঘটলেও যেন সময়মত যেন যথাস্থানে পৌঁছা যায়।
৪.চিন্তাশূন্য, আত্মকেন্দ্রিক লোক এড়িয়ে চলা : আপনার সময় ক্ষেপণ হতে পারে এমন চিন্তাশূন্য, আত্মকেন্দ্রিক লোক এড়িয়ে চলা ভাল। তবে বড়দের কাছে গেলেও অনেক সময় কালক্ষেপণ হতে পারে।
৫.চিঠিপত্র বা টেলিফোনে সবসময় কাজ সেরে নেয়া ঠিক নয় : চিঠি বা টেলিফোনে সেরে নেয়া যায় এমন কাজের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে না যাওয়াই ভাল। তবে অফিসিয়াল ক্ষেত্রে, বড়দের ক্ষেত্রে কেবল টেলিফোনে সেরে নেয়ার চিন্তা করা যাবে না।
৬.সব সময় কাছে খুচরা টাকা রাখা : রাস্তায় চলতে রিক্সা ভাড়া, বাস ভাড়া ইত্যাদির জন্য সব সময় কাছে খুচরা টাকা রাখবেন। যেন খুচরা করতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট না হয়।
৭.সাক্ষাতের জন্য পূর্বেই সময় নেয়া : কারো সাথে সাক্ষাত করে কথা বলতে চাইলে পূর্বেই সময় নিয়ে নিবেন এবং কত সময় কথা বলবেন তাও জানিয়ে নিবেন।
সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়ায়
আপনি কি মনে করেন আপনি এখন যে পরিমাণ কাজ করছেন তার চেয়ে বেশি কাজ করা আপনার পক্ষে সম্ভব? আপনি কেন তা পারছেন না তা কি উপলব্ধি করতে পারছেন? কিছু নিয়ম যদি আপনি প্রত্যেকদিন নিয়মমাফিক ভাবে অনুসরণ করেন তবে আপনি একদিনে যে পরিমাণ কাজ করতে চাইছেন তার চেয়ে বেশি কাজ করতে পারবেন। আসুন জানা যাক, সেই নিয়মগুলো কি?

১.গুরুত্বের ভিত্তিতে কাজের একটা তালিকা তৈরি করুন : যে কাজটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটাকে উপরে রেখে ও কম গুরুত্বপূর্ণ কাজটিকে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে প্রাত্যহিক কাজের একটা তালিকা তৈরি করুন। যেই কাজটি শেষ করবেন সাথে সাথে ওটাতে ক্রস চিহ্ন দিন। এভাবে একটা একটা করে কাজগুলো শেষ করুন।
২.কিছু কাজ অন্যকে দিয়ে করান : সব কাজ নিজে করতে গেলে একজন মানুষের উপর খুব বেশি চাপ পড়ে যায়। এর ফলে কোন কাজই ভালমত করা সম্ভব হয় না। সুতরাং, কিছু কিছু কাজ অন্যকে দিয়ে করানোর ব্যবস্থা করুন।
৩.সবকিছু গুছিয়ে নিন : যেকোন কাজ গুছিয়ে করলে খুব সহজে ও খুব তাড়াতাড়ি করা যায়। সুতরাং, কাজগুলোকে গুছিয়ে করার চেষ্টা করুন।
৪.বসকে মাঝে মাঝে না বলুন : বস মাঝে মাঝে আপনার উপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে। এসময় খুব সচেতনভাবে ও ভদ্রতার সাথে বসকে ‘না’ বলার চেষ্টা করুন। অন্যথায় বসের কাজ করতে করতেই আপনার দিন শেষ হয়ে যাবে।
৫.গড়িমসি বন্ধ করুন : গড়িমসি আপনার সাফল্যকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যেকোন কাজ করার সময় যেটুকু সময়ের মধ্যে পারা যায় তাতেই কাজটি শেষ করার চেষ্টা করুন। আলস্যবশত একটি কাজে দেরি করলে অন্য কাজগুলোতে এর জন্য ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
৬.যথেষ্ট ঘুমানোর চেষ্টা করুন : রাতে ভালো ঘুম না হলে কারও পক্ষেই দিনের বেলা ভালোমত কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এর ফলে দিনের বেলা কোন কাজই শেষ করা সম্ভব নাও হতে পারে। সুতরাং, যথাসময়ে ঘুমিয়ে নিজের সময়কে ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করুন।

সময় ব্যবস্থাপনা ও আমাদের করণীয়
মানুষের জীবনের সাথে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেটি হচ্ছে সময়। প্রতিটি কাল, ক্ষণ, মুহূর্ত আমাদের জন্য এতই মূল্যবান যে সেটি আমরা উপলব্ধিই করতে পারছি না। কারণ আমরা সময়ের সঠিক মূল্য দিতে জানি না । পাশ্চাত্য দেশে বলে `Time is money’ অর্থাৎ সময়ই হচ্ছে অথ”এই সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে রয়েছে নানাবিধ মতামত, পরামর্শ বা সমাধান। উৎপত্তিগত অর্থে : সময়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Time. Time শব্দটি এসেছে Latin ভাষা থেকে। Tempus থেকে Time এসেছে। যার অর্থ কোনো কিছু ঘটে অতীত হয়ে যাওয়া বা যাহা চলমান Time is the soul of work. It is the basic structure of human life. It is the root of human success in everywhere. সময় হলো কাজের আত্মা। এটা মানুষের জীবনের মৌলিক কাঠামো। সর্বত্র মানুষের সাফল্যের রুট। T = taste of, I = Income as, M = Money in, E = Everywhere. উক্ত শব্দটি Time বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় যে, Taste of Income as Money in Everywhere. অর্থাৎ সর্বত্রই সময়ের মধ্যে টাকা নিহিত। সময়ই সকল অর্থের মূল উৎস। সময়ের ব্যবহারই কাজ, আর কাজের প্রয়োগ হলো টাকা। সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ আসে। আসে জীবনের উন্নতি। আসে কর্মে উদ্দীপনা, পেশাগত উন্নয়ন, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের অগ্রগতি এবং সর্বোপরি জাতীয় উন্নয়ন।

সময়ের মর্যাদা : সময় তার আপন গতিতে চলে। কারো জন্য এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না। এটা এমন এক অমূল্য সম্পদ যা হারালে আর পাওয়া যাবে না। পাশ্চাত্যে সময়কে বলা হয় অর্থ কিন্তু একজন মুসলমানের জীবনে সময়, অর্থ, স্বর্ণ, হীরা, মহরত, মনি, মুক্তা সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের প্রকৃত নাম মূলত জীবন। সময় ব্যবস্থাপনার মূলমন্ত্র হচ্ছে সময়ের প্রকৃতি ও গুরুত্ব অনুধাবন করা। সময় আল্লাহর এমন এক অনবদ্য সৃষ্টি যা মেঘের মতো নি:শেষ হয়ে যায়। বাতাসের মতো ধাক্কা দিয়ে চলে যায় আর ফিরে আসে না।

সময়ের বৈশিষ্ট্য

১.সময় অস্থায়ী।
২.সময় গেলে আর ফিরে আসে না।
৩.সময় মহামূল্যবান সম্পদ।
৪.সময়ের মাধ্যমে জীবন গঠিত হয়।
৫.সময় সর্বদাই চলমান, যার গতি রোধ করা যায় না।
৫.১ যেহেতু সময় বহমান/চলমান একে নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ করে নেয়াই শ্রেয়।
৫.২ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের সকল কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে।
৫.৩ আপনার কাজ আপনাকেই সম্পাদন করতে হবে।
৫.৪ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের বিভাজন করে সম্পাদন করতে হবে।
৫.৫ পরিকল্পিতভাবে সময়ের ব্যবহার করতে হবে।
৫.৬ অল্প সময়ের মধ্যে সুন্দরভাবে অধিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
৫.৭ সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে হবে।
৫.৮ সময়ের ভারসাম্য আনয়ন করতে হবে অনর্থক অপরিকল্পিত সময় ব্যয় থেকে বিরত থাকতে হবে। সর্বোপরি সময়ের অপচয় রোধ করতে হবে।
সময় অপচয়ের কারণ :

দিনের কাজে কোনো পরিকল্পনা না থাকা। জীবনের লক্ষ্য না থাকা। সময় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা বা কৌশল না জানা। অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাজের তালিকা না থাকা। অপ্রত্যাশিত কাজ চলে আসা। নিজের অলসতা, আড্ডাবাজি মানসিকতা। সর্বোপরি সময়কে মহামূল্যবান বস্তু মনে না করা।

সময় অপচয়ের উপাদান :

একেক শ্রেণির জন্য সময় অপচয়ের পার্থক্য রয়েছে। যিনি শিক্ষক তার সাথে ছাত্রের সময় অপচয়ের উপাদানের ভিন্নতা রয়েছে। তেমনিভাবে কর্মকর্তা কর্মচারী, গৃহিণী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী শ্রমিকদের সময় অপচয়ের উপাদানে ভিন্নতা রয়েছে।
সময় অপচয় না করে সময়কে পরিকল্পিত ও যথাযথভাবে কাজে লাগান। সময়কে পরিকল্পিত ও যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য সুষ্ঠু ও সুষম সময় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে মোতাবেক নিজের জীবন পরিচালনা করুন। তাহলে সময় ব্যবস্থাপনা আপনার জীবন বদলে দিবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দেবে।

সূত্রঃ নতুনকণ্ঠ
favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment