খেলায় সেরা, পড়ায় সেরা
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
বাংলাদেশের অনেক কিশোর-তরুণ এখন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ক্রিকেট কিট ব্যাগটা কাঁধে তুলতে গিয়ে বইয়ের ব্যাগটা নামিয়ে রাখছেন কেউ কেউ। কিন্তু খেলাধুলা আর পড়ালেখা—দুটোই তো চলতে পারে সমানতালে। চলমান চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও এমন বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা খেলা-পড়া দুটোতেই সেরা।
জুলাই, ২০০১। হারারের টেস্ট ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলছিল স্বাগতিক জিম্বাবুয়ে। নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যারিবীয় বোলারদের নাজেহাল করে সেঞ্চুরি হাঁকালেন অভিষিক্ত এক জিম্বাবুইয়ান তরুণ। তাঁর বয়স তখন ১৭ বছর ৩৫৪ দিন। অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে কম বয়সের সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ডবুকে লেখা হলো নতুন একটি নাম—হ্যামিলটন মাসাকাদজা (যদিও দুই মাস পর সেই রেকর্ড ভেঙে ফেলেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল)।
অভিষেকেই দারুণ এই কীর্তির পর মাসাকাদজা দলে থিতু হবেন, এটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের ভাবনা ছিল ভিন্ন। ক্রিকেট ব্যাট-প্যাড শোকেসে তুলে রেখে তিনি বই হাতে ছুটলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চশিক্ষার জন্য গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনিভার্সিটি অব ফ্রি স্টেটে।
সেই সময়ের জিম্বাবুয়ে দলটি কিন্তু বর্তমান দলের মতো ছিল না। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিকদের জিম্বাবুয়ে তখন যেকোনো দলের জন্যই বিপজ্জনক। এমনকি বাংলাদেশকেও বলেকয়ে হারিয়ে দিত তারা। এই গ্রেট খেলোয়াড়দের ভিড়ে দলে জায়গা পাওয়াই ছিল কঠিন। আর মাসাকাদজা কিনা জায়গা পেয়ে নিজেই ছেড়ে দিলেন? তাও আবার লেখাপড়ার জন্য? লেখাপড়াটা তো পরেও করতে পারতেন, এমন ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মাসাকাদজা হয়তো ভেবেছিলেন উল্টোটা—ক্রিকেট তো পরেও খেলতে পারব, আগে লেখাপড়াটা শেষ করে নিই। লেখাপড়া শেষ করার পর কিন্তু ঠিকই আবার দলে ডাক পেয়েছিলেন মাসাকাদজা। পরে রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর নানা জটিলতায় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটটা পিছিয়ে না গেলে হয়তো অন্যরকমই হতো তাঁর ক্যারিয়ার রেকর্ড।
তবে ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ক্রিকেট ছেড়ে লেখাপড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটাকে বেশ সাহসীই বলতে হবে। যে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। কোনটা ছাড়ব—পড়া নাকি খেলা? এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়। তবে খেলার সঙ্গে পড়ালেখার বিরোধ যে নেই, সে সম্পর্কে একটা ধারণা কিন্তু পাওয়াই যায় মাসাকাদজার এই ঘটনা থেকে। ‘আমি তো খেলোয়াড় হব’ টাইপ চেতনা নিয়ে লেখাপড়া একেবারে ছেড়ে দেওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বটে। কারণ, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। সবাই তো আর ডব্লিউ জি গ্রেস নন! অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ ভালো করছে বাংলাদেশ দল। ধারাবাহিক সাফল্যের কারণেই অসংখ্য কিশোর-তরুণ এখন স্বপ্ন দেখছে ক্রিকেটার হওয়ার। পরিবার থেকেও সমর্থন আসছে। স্কুলে নিয়ে যাওয়ার মতো করে ছেলেমেয়েকে ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতেও নিয়ে যাচ্ছেন মা-বাবা। ছেলেমেয়েরা মাঠে অনুশীলন করছে, দূরে বসে তা দেখছেন অভিভাবকেরা—এখন নিয়মিত হলেও একসময় কল্পনাই করা যেত না সে দৃশ্য। খেলাটার প্রতি ভালোবাসা তো আছেই, পেশা হিসেবেও এখন ক্রিকেটকে বেছে নিতে চায় অনেকে। আর প্রশ্নটা ওঠে তখনই, ‘আমি তো ক্রিকেটার হব, লেখাপড়া করার কী দরকার?’ অনেক কিশোর-তরুণ বইয়ের ব্যাগটা ঘরের কোণে ফেলে রেখে ক্রিকেট কিটব্যাগকেই করে ফেলেন সব সময়ের সঙ্গী। ঠিক এ কাজটাই করেছিলেন ঢাকার মিরপুরের তরুণ ক্রিকেটার শরীফ (ছদ্মনাম)। দারুণ খেলতেন তিনি। বোলিং-ব্যাটিং দুটোতেই সমান পারদর্শী। মিরপুরের স্থানীয় এক ক্লাব পেরিয়ে সুযোগ পেয়ে যান দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে খেলার। ধীরে ধীরে ক্রিকেটটাই হয়ে ওঠে শরীফের ধ্যান-জ্ঞান। একসময় ‘ছাত্র’ পরিচয়টা হারিয়ে বড় হয়ে ওঠে ক্রিকেটার পরিচয়টা। তারপর হঠাৎই ছন্দপতন। খেলতে গিয়ে আঘাত পেয়ে বাধ্য হন ক্রিকেট থেকে সরে আসতে। কিন্তু তত দিনে বয়সটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে আবার লেখাপড়া শুরু করাটা বেশ কঠিন। বাধ্য হয়ে বাবার ব্যবসায় সময় দিতে শুরু করেন শরীফ। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের খেলা দেখে উল্লসিত হওয়ার পরক্ষণেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর ভেতর থেকে, ‘ইশ, লেখাপড়টাও যদি চালিয়ে যেতাম…।’
এই আক্ষেপটা কিন্তু তাড়িয়ে বেড়াবে দীর্ঘ সময়। সাধারণ একজন তরুণের কর্মজীবন শুরুই হয় মোটামুটি ৩০ বছর বয়সে, যখন একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের গোধূলিকাল। এরপরেই কিন্তু একটা দীর্ঘ জীবনের হাতছানি। তাই বিকল্প কিছু ভেবে রাখলে ক্ষতি কি? তা ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন যে ধরনের তীব্র প্রতিযোগিতা, সেই একই প্রতিযোগিতা-সীমাবদ্ধতা কিন্তু অন্য সব পেশাতে বিদ্যমান। তাই পড়ালেখা আর খেলা দুটোকেই পাশাপাশি রেখে এগোনো যায় কি না, সেটি ভালোভাবে ভেবে দেখা দরকার।
খেলা আর পড়ালেখা—সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি জগৎ হলেও এর মধ্যে সমন্বয় করে সফল হয়েছেন এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। যেমন আমাদের টেস্ট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। উইকেটের সামনে-পেছনে যেমন ‘ফার্স্ট ক্লাস’ তিনি, তেমনি ফার্স্ট ক্লাস লেখাপড়াতেও। মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিষেক হয় মুশফিকের, তখনো তিনি ছাত্র। খেলতে খেলতেই একে একে ছক্কা হাঁকিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক সব পরীক্ষাতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন, তা-ও প্রথম শ্রেণি পেয়ে। ভবিষ্যতে পিএইচডি বা এমবিএ করারও ইচ্ছা আছে বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিমের।
খেলার পাশাপাশি লেখাপড়া করছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, তাসকিন আহমেদসহ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অনেকেই। কেউ পড়ছেন বিবিএ, কেউ বা এমবিএ।
বর্তমানে ক্রিকেটারদের আয়, সম্মান দুটোই বেশি। তারপরও লেখাপড়া ছাড়েননি অনেকে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি মাতাবেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই আলো ছড়াচ্ছেন শিক্ষার অঙ্গনেও। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের কথাই ধরুন। তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে তাঁর। আজিঙ্কা রাহানে কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার প্যাট কামিন্সও ব্যবসায় শিক্ষায় ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী। নিউজিল্যান্ডের বাঁ হাতি ফাস্ট বোলার মিচেল ম্যাকলেনাগন মার্কেটিং ও অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়েছেন অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে। তাঁরই টিমমেট মিচেল স্যান্টনার যন্ত্রকৌশল নিয়ে পড়েছেন ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নেলসন ম্যান্ডেলা মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম ‘সম্পদ’ বাঁহাতি পেসার ওয়েইন পারনেল। আরেক বাঁহাতি পেসার পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজ বিএসসি, এমএসসি দুটোই শেষ করেছেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে তাঁর অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের নামের পাশেও। দাউদ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে প্রকৌশলে ডিগ্রি নিয়েছেন পাকিস্তান এই অধিনায়ক।
শুধু যে বিবিএ-এমবিএ কিংবা প্রকৌশল পড়তে হবে তা নয়, যে বিষয় ভালো লাগে পড়া উচিত সেটাই। ইংলিশ ব্যাটসম্যান স্যাম বিলিংস যেমন লেখাপড়াও করছেন খেলা নিয়েই। লোঘবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন ‘স্পোর্টস অ্যান্ড এক্সারসাইজ সায়েন্স’।
‘পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলা’—এ কথা কে না জানে! সময়কে ঠিকভাবে ভাগ করে নিলে দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া এমন কঠিন কিছু নয়। তা ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই খেলোয়াড়দের জন্য কিছু ছাড় থাকে। ভালো খেলোয়াড়েরা শিক্ষক, সহপাঠীদের সহায়তা পান বরাবরই। মুশফিকুর রহিমও এক সাক্ষাৎকারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমার যতটা কৃতিত্ব, তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেব আমার শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এটা কখনোই সম্ভব হতো না। অনেক সময় ক্লাস করতে পারতাম না, বন্ধুদের নোট নিয়ে পড়তাম। অ্যাটেনডেন্সে সমস্যা হলেও স্যাররা আমাকে কনসিডার করেছেন। আমাকেও কষ্ট করতে হয়েছে। তারপরও যখনই সময় পেয়েছি ক্লাস করেছি।’ (মুশফিকুর রহিম এমএ, প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০১২)
ক্রিকেট যেমন অনিশ্চয়তার খেলা, তেমনি অনিশ্চিত আমাদের জীবনটাও। সেখানে খেলাধুলার পাশাপাশি লেখাপড়া কিংবা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা দুটোই করলে ক্ষতি কী? বিকল্প থাকলে আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে সুযোগও। আর সুযোগটা তো বারবার আসে না, তাই খুব বেশি সমস্যা না হলে খেলা-পড়া—দুটোই চলতে পারে পাশাপাশি।