বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বিষয়ক ১০ প্রশ্ন

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বিষয়ক ১০ প্রশ্ন

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক

কয়েক দিন পরই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। বিষয় নির্বাচন, আবেদন বা পরীক্ষার পদ্ধতি, পরীক্ষার নিয়মকানুনসংক্রান্ত অনেক প্রশ্ন ভর্তি-ইচ্ছুকদের মনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে পরিচিত ১০ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তাহমিদ উল ইসলাম


১. কোচিং কি করতেই হবে?

ভর্তি কোচিং নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে অনেক প্রশ্ন। কোচিং কি করতেই হবে? কোথায় করব? ভালো কোচিং খুঁজব, নাকি খুঁজব কোনটা বাসার কাছে? উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এমন অনেক জিজ্ঞাসার কথা জানা গেল। উত্তরের খোঁজে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাওয়াদ আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি ২০১৬ সালে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় পঞ্চম হয়েছেন। জাওয়াদ বললেন, ‘কোচিংয়ে যে ভর্তি হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। বাসায় বসে কেউ যদি নিয়মিত পড়তে পারেন, তাহলে তো খুবই ভালো। আবার একগাদা কোচিংয়ে ভর্তি হয়েও কেউ যদি বাসায় না পড়েন, তাহলে ফল হবে শূন্য। তবে নিয়মিত অনুশীলনের জন্য কোচিংয়ের পরীক্ষাগুলো সহায়ক। আমি মনে করি, বাসার কাছের কোচিংয়ে ভর্তি হওয়াটাই উচিত। বিশেষ করে ঢাকা শহরে কোচিংয়ে যাওয়া-আসা করেই যদি একটা বড় সময় নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে।’

২. পাঠ্যবই আগে? নাকি কোচিংয়ের গাইড?

এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। মনে রাখতে হবে, প্রশ্নকর্তারা কিন্তু গাইড দেখে প্রশ্ন করবেন না। তাঁরা মূল বই থেকেই প্রশ্ন করবেন। অতএব গাইড বা নোটের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল না হওয়াই ভালো মনে করেন আগের বছরের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করা শিক্ষার্থীরা। ২০১৭ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী স্বপ্নীল আবদুল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘এইচএসসির পাঠ্যবইকে প্রাধান্য দেওয়াই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। মূল একটি বইকে রেফারেন্স হিসেবে ভালোভাবে পড়ে নিলে অনেকাংশই আয়ত্তে চলে আসে, ধারণাও থাকে পরিষ্কার। অতিরিক্ত তথ্য ও অনুশীলনের জন্য কোচিংয়ের বইয়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এই সহায়ক বইগুলোতে অনেক সময়ই অসংগতি, ভুলভাল তথ্য থাকে।’

৩. ভর্তির জন্য কী কী কাগজ তৈরি রাখব?

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময়, ভর্তি পরীক্ষার দিন এবং ভর্তির সময় কিছু কাগজ তৈরি রাখা জরুরি। এর ফলে সময়ের অপচয় রোধ করা যায়। শেষ মুহূর্তে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের মূল কপি, মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের সনদ, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার নিবন্ধনপত্র ও প্রবেশপত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, কলেজ থেকে সংগৃহীত প্রশংসাপত্র, সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি (প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়িত হলে ভালো)—এসব কাগজপত্র একটি ফাইলে গুছিয়ে রাখা যেতে পারে। এর বাইরে যত্নে রাখা চাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য ইস্যুকৃত প্রবেশপত্রও। এসব কাগজপত্রের মূল কপির পাশাপাশি ফটোকপিও রাখাটা কাজে দেয়।

৪. কোন বিশ্ববিদ্যালয় কবে থেকে ফরম ছাড়বে, আবেদনের নিয়মকানুন বা ভর্তির যোগ্যতা কী…এসব তথ্য পাব কোথায়?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসংক্রান্ত তথ্যের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র হলো দৈনিক পত্রিকা এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। তবে অবশ্যই অসমর্থিত কোনো সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্বাস করা যাবে না। কখনোই ধরে নেওয়া যাবে না যে গতবার যেই নিয়ম ছিল, এবারও সে নিয়মই থাকবে। বন্ধুদের মুখে মুখে যে তথ্যটা ছড়িয়ে যায়, সেটা অনুসরণ করার আগে নিজে যাচাই করে নেওয়া ভালো। ছোটখাটো ভুলের কারণে পরে যেন আফসোস করতে না হয়।

৫. এক শহর থেকে আরেক শহরে পরীক্ষা দিতে গেলে থাকব কোথায়?

‘ভর্তি পরীক্ষার সময় অনেকেই দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেন। এ ক্ষেত্রে থাকার ব্যাপারটি অনেক সময় একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন এমন সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাঁরা আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন,’ বলছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিরাজাম মুনিরা। তিনি মনে করেন, হলে থাকতে অনিচ্ছুক হলে বা থাকার উপায় না থাকলে আবাসিক হোটেল কিংবা আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও থাকা যেতে পারে। তবে দেশের প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষার আগে হলের শিক্ষার্থীরা পরিচিত ছোট ভাই-বোনদের হলে থাকার সুযোগ করে দেন।

৬. পছন্দের বিষয়, নাকি পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়? কোনটিকে অগ্রাধিকার দেব?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা একটু কঠিন। কারণ, ব্যক্তি ও পরিস্থিতিভেদে উত্তর ভিন্ন হতে পারে। যদি এমন হয়, আমি পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম না, কিন্তু অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়টা পেয়ে গেলাম, তাহলে কী করব? রবি টেন মিনিটস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক কী মনে করেন? আয়মান বললেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তরটা আমার ক্ষেত্রে একটু আবেগতাড়িত হয়ে যাবে। আমি যখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, তখন হয়তো বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দিতাম। তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে বুঝি, বিষয়ের চেয়ে কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু বড় ভূমিকা রাখে। তাই এখন পরামর্শ দিতে হলে বলব, পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। কিন্তু আমার যদি বিষয়টির প্রতি প্রচণ্ড “প্যাশন” থাকে, যদি মনে হয় যেখানেই পড়ি না কেন, এই বিষয়ে আমি ভালো করবই—তাহলে সেটাও করা যায়।’

৭. আমি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

‘আমি বলব, শুধু একটি জায়গার ফরম তোলাটা উচিত হবে না। অন্তত একটি বিকল্প পরিকল্পনা রাখা দরকার। ভর্তি পরীক্ষায় অনিশ্চয়তা খুব সাধারণ ব্যাপার। যেকোনো কিছুই হতে পারে। প্রস্তুতি খুব ভালো হলেও অসুস্থতা বা কোনো দুর্ঘটনাবশত পরীক্ষা খারাপ হতেই পারে। তাই আমার মতে, বিকল্প হিসেবে একটি লক্ষ্য ঠিক করে রাখা দরকার। অনেক সময় একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নের ধরন কাছাকাছি হয়। এই সুযোগটা কাজে লাগানো যেতে পারে,’ বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম হোসাইন আহমেদ। তাঁর মতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়াটা শ্রমের অপচয় নয়। বরং এতে খুব ভালো অনুশীলনও হয়।

৮. একই সময় যদি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পড়ে যায়, তখন কী করব?

একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি বিপাকে ফেলে ছাত্রছাত্রীদের। সমস্যাটি নিয়ে কথা বলছিলাম কুমিল্লা মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজনীন ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টির ভুক্তভোগী আমি নিজেই। আমার অনেক বন্ধুরও এই বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত হতে দেখেছি। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন, কোন বিষয়টির প্রতি আগ্রহ বেশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেমন, কোনটির জন্য প্রস্তুতি বেশি ভালো—ইত্যাদি।’

৯. যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নিয়েছি, বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর যদি দেখি সেখানে পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই, তাহলে কী করব?

এ ক্ষেত্রে ভেঙে পড়লে চলবে না। কখনো কখনো একটা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে অন্য একটা দরজা খুলে যায়। দীপঙ্কর তালুকদার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকেই কিন্তু তিনি ভালো ফল করেছেন, হয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানী। লাইগো নামের সুবিশাল এক যন্ত্রের সাহায্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল যেই বিজ্ঞানীদের দল, তিনি তাঁদের একজন। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ নিশ্চয়ই আশপাশে পাওয়া যাবে।

১০. কম খরচে কি কোনো ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ আছে?

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে যাঁরা ভালো ফল করেছেন, তাঁদের জন্য নানা রকম বৃত্তির সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে এই বৃত্তির খোঁজ পাওয়া যাবে। আবার যাঁরা বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে পুরস্কার পেয়েছেন বা ভালো করছেন, যেমন খেলাধুলা, বিভিন্ন অলিম্পিয়াড বা উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতা, তাঁদেরও বৃত্তি দেয় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া, ভর্তি হওয়ার পর ভালো ফল করলেও টিউশন ফিতে ছাড় পাওয়া যায়। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। এ সম্পর্কে জানতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খোঁজ করা দরকার।

সূত্র : প্রথম আলো

Sharing is caring!

Leave a Comment