নোট লেখা জরুরি কেন?
- তানজিয়া তাসনিম আদিবা
ব্যাপারটা কেমন হয় যদি আমি বলি যে ‘নোট’ নামক জিনিসটার আসলেই কিছু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? নোট ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের গতানুগতিক চিন্তা হলো নোট শুধু আঁতেলরাই করে। কিন্তু ঘটনাটা সেরকম না। নোট সবারই করা উচিত। তুমি বিশ্বাস করো আর না-ই করো, ইনস্টাগ্রামে #StudyingHard #ExamIsHere ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ দিয়ে ছবি আপলোড করা ছাড়াও নোট নামক জিনিসটার কিছু গুরুত্ব রয়েছে। আর সেটা তখনই, যখন তুমি সুন্দর এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে নোট করতে পারছো।
১. নোট কত প্রকার ও কী কী
নোট জিনিসটা ক্লাসের লেকচার নোটসও হতে পারে আবার বাসায় করা বিশদ নোটসও হতে পারে। ক্লাসে শিক্ষক কী বললেন সেগুলো শর্টহ্যান্ডে লিখে রাখাটাও নোট আর বাসায় এসে শিক্ষকের বলা কি-ওয়ার্ডস এবং পয়েন্টসগুলো ব্যাখ্যা করে খাতায় লেখাটাও নোট। সোজা কথায় ক্লাস নোট হচ্ছে হেডলাইন, আর বাসার নোট হচ্ছে বিস্তারিত খবর।
২. কীভাবে শুরু করব
খুব ভালো হয় যদি প্রত্যেকটা কোর্স বা সাবজেক্টের জন্যে আলাদা নোটবুক (খাস বাংলায় ‘খাতা’) রাখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই তোমার যদি চৌদ্দটা সাবজেক্ট থাকে তাহলে চৌদ্দটার জন্য চৌদ্দটা দুইশো পেইজের খাতার ব্যবস্থা করা আর সেগুলো নিয়ে ক্লাস থেকে ক্লাসে দৌড়াদৌড়ি করা একটু ঝামেলা হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে পাতলা পাতলা খাতার ব্যবস্থা করো, দরকার হলে প্রয়োজনমত কাগজ কিনে খাতা বানিয়ে নাও। আর এছাড়া ফাইল অর্গানাইজার বলে একটা জিনিস পাওয়া যায়, সেটার মধ্যে আলাদা আলাদা পকেটের মত ভাগ করা থাকে, যেগুলোতে বিষয়ভিত্তিক লেকচার শিট বা হ্যান্ড আউটস রাখতে পারো। বিভিন্ন কালির কলম, হাইলাইটার তোমার নোটকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলবে।
৩. ক্লাসে ঘুমানো বন্ধ করো
ক্লাসে শিক্ষক প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত যত আড্ডা যত খাওয়া-দাওয়া যত ঘুম আছে একটু শেষ করে নিতে পারলে ভালো হয়। শিক্ষক প্রবেশের সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যাও কারণ তোমার নোট নিতে হবে। কে আঁতেল বলল, কে Teacher’s Pet বলল সেদিকে নজর না দিলেও চলবে কারণ ওরাই পরে তোমার কাছে নোট চাইতে আসতে পারে, আর এই ফাঁকে তুমি দু’একটা ফুচকা/চকলেট/চিকেন ফ্রাই ট্রিটও পেয়ে যেতে পারো। টিচার যখন কথা বলছেন তখন তার মৌখিক এক্সপ্রেশন গুলোর দিকে খেয়াল করো। “আমি প্রশ্ন করলে এই টপিকটা অবশ্যই রাখবো”, “এই জিনিসটা তোমাদের পরীক্ষার জন্যে ইম্পরট্যান্ট” কিংবা “তোমরা চাইলে এটা লিখে রাখতে পারো” –শিক্ষক এগুলো বলা মানেই তখন তোমার ঐ ব্যাপারটা নোট করতে হবে। আর হ্যাঁ, নোট শুরু করার আগে তারিখ, টাইটেল, রেফারেন্স ইত্যাদি লিখে নিতে ভুলবে না।
৪. ইফেক্টিভ নোট টেকিং
ক. এসো লেখা শিখি
নোট একটা করেছো, সেটা কাজে যাতে লাগে তার প্রধান শর্ত হচ্ছে পরিষ্কার হাতের লেখা। পরিষ্কার বলতে সুন্দর মুক্তোর মতো না হলেও চলবে। বেশি কাটাকাটি, মোছামুছিবিহীন পরিচ্ছন্ন একটা লেখা হতে হবে, যাতে ক্লাসের পরে ওটা পড়ে বুঝতে পারো যে কী ক্লাস করেছো। ক্লাসের মধ্যে নোট নিতে যেয়ে আবার এমন যেন না হয় যে টিচার কী কনসেপশন বুঝিয়েছেন ঐটাই ধরতে পারো নাই।
বিভিন্ন শর্টহ্যান্ড পদ্ধতি, abbreviations, symbols ইত্যাদি ব্যবহার করে বিশাল ব্যাখ্যাটা ছোট করে অথচ সহজবোধ্য করে লিখে ফেলো। “দুই অণু হাইড্রোজেন আর এক অণু অক্সিজেন মিলে দুই অণু পানি হয়” লেখার চেয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়াটা লিখে ফেলা সোজা না? অনেকটা ঐরকম। লেখার ক্ষেত্রে নিজের স্টাইলটা বুঝে নাও, কোনভাবে লিখলে পরে সেটা তোমার বুঝতে ও মনে করতে সুবিধা হবে, সেটা তোমার নিজেরই বের করতে হবে। স্যার একটা শব্দ নিজের ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন বলে ঐটাকেই বেদবাক্য ধরে ঐভাবেই মুখস্থ করতে হবে এমনটা কোনো শাস্ত্রে লেখা নেই। তুমি তোমার মত rephrase করে, নিজের ভাষায় নিজের সুবিধামতো নোট লিখবে।
খ. নোট করার কর্নেল মেথড
কর্নেল মেথড বলে একটা জিনিস আছে যেটা আমিও জানতাম না, এখন আমি এটা করার চেষ্টা করি। খাতার পৃষ্ঠার নিচের দিকে মোটামুটি পৃষ্ঠাটার এক-চতুর্থাংশ জায়গা নিয়ে এমাথা থেকে ওমাথা একটা Horizontal দাগ টানো। এবার পৃষ্ঠার বাম দিক থেকে দুই-আড়াই ইঞ্চি মত জায়গা নিয়ে Horizontal লাইনের ওপর একটা ভার্টিকাল লাইন টানো। পৃষ্ঠার ডানদিকে যে চারকোণা ভাগটা হলো, সেখানে তুমি নোট লিখবে। বামদিকের অপেক্ষাকৃত চিকন ভাগটাতে, তুমি তোমার লেখা নোটগুলোকে আবার পড়ে ক্ল্যারিফাই করে দুর্বোধ্য ব্যাপারগুলো সোজা করে লিখবে। আর একদম নিচের আয়তাকার ভাগটাতে পুরো টপিকটার সারমর্ম লিখবে। এইটা নোট লেখার পরীক্ষিত কার্যকর পদ্ধতি, এভাবে লিখলে বোঝার ও মনে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
গ. স্কেচনোটস
স্কেচনোট জিনিসটা হলো নোটটাকে আরো বেশি অর্গানাইজড দেখাবার উপায়। পয়েন্ট করার জন্যে বুলেট, ফ্রেম, কানেক্টর, হাতে লেখা যায় এমন বিভিন্ন ফন্ট, বিভিন্নরকম চিহ্ন, আন্ডারলাইন করা, সার্কেল করা ইত্যাদি। এটা ক্লাস নোটেও এপ্লাই করতে পারো, বাসায় বসে যখন সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখবে তখনো ট্রাই করতে পারো। বিভিন্ন ফ্লোচার্ট ডায়াগ্রাম যেগুলো বইতে নেই অথচ তুমি বোঝার সুবিধার্থে নিজেই বানিয়ে নিতে পারছ, এগুলো তোমার কনসেপ্ট ক্লিয়ার রাখতে সাহায্য করবে। বিভিন্ন কালির কলম হাইলাইটার – এগুলোর কথা তো আগেই বললাম। বিভিন্ন টার্মিনোলজি, সংজ্ঞা, শব্দার্থ আলাদা আলাদা কালিতে মার্ক করলে মনে রাখাটা সোজা হয়। এত সুন্দর করে গুছিয়ে লেখার ওপর জোর দিচ্ছি বলে নোটখাতাকে একেবারে ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী বানিয়ে ফেলতে হবে এমন কোন কথা নেই। নোট করার মেইন উদ্দেশ্য হচ্ছে তুমি যাতে টপিকটা ভালো বোঝো আর পরীক্ষার আগের রাতে বইখাতা খুললে যাতে সব টপিক ব্র্যান্ড নিউ মনে না হয়।
৫. আপু, আর কিছু বলবেন?
হ্যাঁ, এত কথা যখন বলেই ফেলেছি তখন আরো কিছু ছোটো-খাটো পয়েন্ট মেনশন করে যাই। তুমি কি জানো যে ক্লাসে যা পড়ানো হয় তার শতকরা ৬০ ভাগই ৯ ঘন্টা পরে তুমি ভুলে যাও, যদি নোট না নিয়ে থাকো। নোট লেখা তোমার এক্টিভ লিসেনিং আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্কিলকে উন্নত করে। আর নোট জিনিসটা টাইপ করে লেখার চেয়ে হাতে লেখাই উত্তম। একটা রিসার্চে ছাত্র-ছাত্রীদের চারটা গ্রুপে ভাগ করে পরীক্ষা নেয়া হয়, জ্ঞানমূলক এবং অনুধাবনমূলক পরীক্ষা। চারটা গ্রুপ এরকম-
১. যারা ল্যাপটপে নোট নিয়েছে অথচ পড়াশোনা করেনি,
২. যারা ল্যাপটপে নোট নিয়েছে এবং পড়াশোনা করেছে,
৩. যারা হাতে লিখে নোট নিয়েছে অথচ পড়াশোনা করেনি এবং
৪. যারা হাতে লিখে নোট নিয়েছে এবং পড়াশোনা করেছে।
জ্ঞানমূলক এবং অনুধাবনমূলক দুইটা পরীক্ষাতেই যে গ্রুপটা তুলনামূলকভাবে অন্য সবার চেয়ে ভালো করেছে সেটা হলো তিন নম্বর গ্রুপটা– যারা হাতে লিখে নোট করেছে কিন্তু পড়াশোনা করেনি।
তাই বলে নোট করে নোটখাতা শোকেসে তুলে রাখতে বলছি না কিন্তু। নোট যখন করেই ফেলেছো সেটা দয়া করে কাজে লাগাও। সেটা পড়াশোনার কাজেই হোক, আর বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ট্রিট নেয়ার কাজেই হোক।
সূত্র: টেন মিনিট স্কুল