ডিগ্রি, নাকি দক্ষতা? কোনটা চাই?
- তাবাস্সুম ইসলাম
তথ্যটি চমকপ্রদ বটে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল কম্পিউটার ইনকরপোরেটেডে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ কর্মীরই স্নাতক ডিগ্রি নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক স্বয়ং এই খবর দিয়েছেন। শুধু অ্যাপল নয়, গুগল, আইবিএম, নেটফ্লিক্সসহ বিশ্বের অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে নন-গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি পাচ্ছেন নিজেদের দক্ষতা, জ্ঞান ও সৃজনশীলতার জোরে।
তাহলে ‘ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, ভালো ফল এবং অতঃপর ভালো চাকরির’ যে বদ্ধমূল ধারণা আমাদের সমাজে আছে, সেটা কি দিন দিন বদলে যাচ্ছে? এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য যথার্থ দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই।
বাড়াতে হবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা
বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে দেখা যায়, বেশ কয়েকটির প্রতিষ্ঠাতাই ড্রপআউটের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। যেমন মাইক্রোসফটের বিল গেটস, ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, টুইটারের জ্যাক ডরসি, ডেলের মাইকেল ডেল, উবারের ট্রেভিস কালানিক, হোয়াটসঅ্যাপের জ্যান কাওম। অতএব তাঁদের কাছে কেন ‘ডিগ্রি’ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটা বোঝা যায়। দেখা যাচ্ছে, নন-গ্র্যাজুয়েট হয়েও ভালো চাকরি পাচ্ছেন তাঁরা, যাঁদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা আছে।
আমাদের দেশে চাকরি পেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেদিকে জোর দিয়েই রবির এইচআর টেক অ্যান্ড ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জাভেদ পারভেজ বললেন, ‘আইটি–সংশ্লিষ্ট কাজেই আসলে ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতার গুরুত্ব বেশি। সে রকম উদাহরণ এখন বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে। যখন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ কাউকে দিই, আমরা কিন্তু জানতে চাই না তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিভাগে পড়েছেন। তিনি কাজটা পারেন কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রযুক্তিগত দক্ষতাগুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিগ ডেটা অ্যানালেটিক্স, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি। এর কোনোটিই সেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেননা, কর্মক্ষেত্রের চাহিদার কথা ভেবে শিক্ষাকার্যক্রমের যে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের রটগার্স স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লেবার রিলেশনের অধ্যাপক বিল ক্যাসেলানো বলেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানই ভবিষ্যতের চাহিদার কথা চিন্তা করে প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। আর এসব দক্ষতা অর্জনের জন্য সার্টিফিকেট নয়, অধ্যবসায় ও উদ্যোগ প্রয়োজন।’
লিংকডইনে হানা ম্যাডি নামের একজন ইউএক্স ডিজাইনারের দেখা মেলে। হানা হাইস্কুলের ধাপও পেরোতে পারেননি, কিন্তু তাই বলে থেমে থাকেনি তাঁর অধ্যবসায়। ডিজাইনিংয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় অন্যান্য কাজের পাশাপাশি নিষ্ঠার সঙ্গে শিখেছেন এর খুঁটিনাটি, বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজের ডিজাইনিং পোর্টফোলিও পাঠিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে তিনি নেটফ্লিক্সে সিনিয়র প্রোডাক্ট ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত। এমন অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। প্রযুক্তিগত দক্ষতা, যেমন ডিজাইনিং, প্রোগ্রামিং, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, ভিডিও এডিটিং, অ্যানিমেশন ইত্যাদি শিখছেন তরুণেরা। বাংলাদেশেও প্রশিক্ষকের কাছে, ইউটিউবের মাধ্যমে তরুণেরা এসব ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা বাড়াচ্ছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুগলের মানবসম্পদ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট লাজলো বক বলেন, ‘কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়া গুগলকর্মীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। গুগলের কিছু কিছু টিমে ১৪ শতাংশ কর্মীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি নেই।’ অনেকেই হয়তো লাজেলোর কথা থেকে ধরে নেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি তাহলে নিছক মূল্যহীন একটি ব্যাপার। তাই লাজেলো সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না।’ এরপর যোগ করলেন, ‘পরীক্ষায় কেউ ভালো ফল করলে বা ভালো গ্রেড পেলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। তবে গুগলে চাকরি পেতে গণিত ও কম্পিউটিং, বিশেষ করে কোড লেখার দক্ষতা জরুরি।’
‘যথার্থ দক্ষতা’র বিষয়টি উঠে এসেছিল সম্প্রতি প্রথম আলো ও বিএসআরএম আয়োজিত ‘মিট দ্য এক্সপার্ট’ অনুষ্ঠানেও। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি রুবানা হক তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রতিদিন আমার কাছে প্রচুর চাকরিপ্রত্যাশী ইন্টারভিউ দিতে আসেন। প্রায় সবাই প্রথাগত বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে যে দক্ষতাগুলো প্রয়োজন, তা তাঁদের নেই। কারণ পড়ার বইয়ের বাইরেও যে আরও অনেক কিছু জেনে-শিখে নিজেকে কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করতে হবে, এ চর্চা আমাদের দেশে এখনো ঠিকভাবে শুরু হয়নি।’
প্রয়োজন সফট স্কিল ও ফাংশনাল স্কিল
সফট স্কিল মূলত আচরণগত ও সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগের দক্ষতা, আবেগজনিত বুদ্ধিমত্তার একটি সামগ্রিক রূপ। আর ফাংশনাল স্কিল হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা প্রয়োগের বিষয়। অর্থাৎ, চমৎকারভাবে আলোচনা বা নেগোসিয়েশন করতে পারা, সাবলীলভাবে সবার সামনে কথা বলতে পারা হলো সফট স্কিল। আর কাজের ক্ষেত্রে যখন দক্ষতাগুলো আপনি কাজে লাগাবেন, তখন তা হয়ে উঠবে ফাংশনাল স্কিল। করপোরেট কোচের মুখ্য পরামর্শক ও মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ যিশু তরফদার বললেন, ‘সফট স্কিল ও ফাংশনাল স্কিলের গুরুত্ব সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। এটি আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে, যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করে।’
যিশু তরফদার বাংলাদেশের তরুণদের প্রেক্ষাপট চিন্তা করে বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন কমিউনিকেশন স্কিল বা যোগাযোগের দক্ষতার প্রতি। তিনি বলেন, ‘কমিউনিকেশন স্কিল ভালো হলে নেটওয়ার্কিং থেকে শুরু করে রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা)—সবই চমৎকারভাবে করা যায়। আর কমিউনিকেশন স্কিল না থাকলে নিজেকে উপস্থাপন করাই কঠিন হয়ে পড়ে।’
সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে চাকরির বাজার, বদলাচ্ছে প্রয়োজনীয় দক্ষতা। সচেতন হয়ে উঠছেন আমাদের তরুণেরাও। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তা তাসনিম বিনতে শাহীনের মতে, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি অনলাইনে নিজের ব্যবসা যখন আমি শুরু করলাম, তখন থেকেই প্রতিনিয়ত আমি শিখছি। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি ক্রেতার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, কীভাবে আমার পণ্যটি উপস্থাপন করতে হবে, ঠিক কীভাবে পণ্যের বিবরণ লিখলে ক্রেতার কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছাবে। ই–কমার্স, এফ–কমার্সের খুঁটিনাটি আমি এখান থেকেই শিখেছি। ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী হিসেবে এগুলো জানা তো আমার জন্য আবশ্যক। কিন্তু শুধু বইয়ের পড়া থেকে আমি এতটা ভালোভাবে এগুলো কখনোই শিখতে পারতাম না।’ তাসনিমের মতো আরও অনেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে আরও বিকশিত করছেন নিজের দক্ষতার ক্ষেত্র, নিজেদের প্রস্তুত করছেন ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের জন্য। সমগ্র বিশ্বের চাকরির বাজারেই ঘটছে বড় এক পরিবর্তন। নিঃসন্দেহে আজ আমরা এমন একসময়ে এসে পৌঁছেছি, যখন পড়ালেখার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র উপযোগী প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছাড়া সামনে এগোনো অসম্ভব।
সূত্র: প্রথম আলো