এ কেমন কল্যাণচিন্তা!
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
মায়েদের এখন প্রধান চিন্তা সন্তানের খুব ভালো একটা ক্যারিয়ার। তাই প্রতিটি মায়ের চাওয়া তার সন্তান লেখাপড়াই শুধু নয়, সবকিছুই প্রথম হবে। আর এজন্য মা নিজে যেমন সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকেন, সন্তানকেও তেমনি তাড়িয়ে বেড়ান প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু ভুলে যান সবকিছুরই একটা সীমা আছে। আর সেটা অতিক্রম করলে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের আশঙ্কাই থাকে বেশি। এসব নিয়ে লেখাটি তৈরি করেছেন সুমাইয়া হাবীবা
মিসেস আলেয়া। ছয় সন্তানের জননী। তার দু’টি মেয়ে। তিনি বললেন, একজন মায়ের টেনশন কোনো দিনই শেষ হয় না। আর যদি সন্তান মেয়ে হয় তাহলে তো বিয়ে দিলেও টেনশন থেকেই যায়। স্বামীরঘর ঠিকমতো করতে পারছে কি না। মেয়েটা সুখী হলো কি না। আবার মেয়ের কোনো দোষ বের হলে তো মাকেই দায়ী করা হবে তাই না! মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনও বলবে। মেয়ের বাবাও বলবে। কথা সত্যি। আমাদের সমাজে হরহামেশাই এমনটি দেখা যায়। সন্তানের বখে যাওয়া বা অন্যায় করার সাথে মায়েদের যুক্ত করে দেয়া হয়। অনেক বাবাও নিজের স্ত্রীকেই দোষারোপ করে থাকেন। এমনটি কেন? বেশ ক’জন মা দায়ী করলেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের হাতে শিশুসন্তান খুন। প্রায় সবগুলোর কারণ হিসেবে একটা কমন ব্যাপার উঠে এসেছে। তা হলো সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা। আগেও এ রকম কিছু কেস দেখা গেছে, যাতে শিশুসন্তানকে হত্যা করে মায়ের আত্মহত্যা। এ কেমন কল্যাণচিন্তা, যাতে সন্তান খুন হচ্ছে মায়েরই হাতে?
বিষয়টিকে খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির। তিনি বললেন, ‘আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমাজব্যবস্থায় মায়েরাই ঘরসংসার ও সন্তান সামলে থাকেন। যুগের পরিবর্তনে মায়েরা বাইরে কাজ করলেও সন্তান সামলানো শুধু মায়েরই কাজ, এ মানসিকতা থেকে অনেকেই বের হতে পারেননি। পুরুষ ঘরের বিষয়ে মাথা ঘামাবে না।
আমাদের বাঙালি পরিবারগুলোতে এ ভুল ধারণাটি নিয়ে বসবাস করার কারণে মায়ের ওপরই সব চাপিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু তিনি মা সেহেতু তারই দায়িত্ব সন্তানকে মানুষ করা। তাই এখনো মায়েদেরই দায়ী করে কথা শোনানো হয়। তাই বলা যায় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে। তবে মূল সমস্যা হলো মানসিকতার দৈন্য। সন্তান দোষ করলে মাকে কেবল বাবাই কথা শোনান না, বরং মহিলাটির শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরাও কথা শোনান। তারা তো সবাই পুরুষ নন। তারা এটা করছেন প্রথা হিসেবে। তাদের মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেই যে নারীকে গ্লানির মধ্যে থাকতে হবে তা নয়। এটি যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি সামাজিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী-পুরুষ সবারই মানসিকতার পরির্বতন দরকার। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানবোধ থাকতে হবে। সমাজব্যবস্থায় পুরুষের অবস্থান থাকবেই। এর বাইরে চিন্তা করা অবাস্তব ও অসুস্থ চিন্তা। বরং পরিবারে, সমাজে নারীর অবস্থান বাড়াতে হবে। বৈষম্য দূর করতে হবে। ব্যালেন্স খুব জরুরি।’
সমস্যা নিয়েই আমাদের সমাজ সংসার। সমস্যার মধ্য দিয়েই মানুষকে চলতে হয়, হয়েছে। আগের চেয়ে সমাজ অনেক উন্নত হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগের মায়েরা এই স্ট্রেসটুকু কেন নিতে পারছেন না? সমস্যা যতই থাকুক নিজ সন্তানকে হত্যা কি সমাধান? মায়েরা কেন এমন চরমপন্থার পথ বেছে নিচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলাম স্কুল অব থিওলজির সাইকোলজিস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং অ্যান্ড গাইডেন্স সেন্টারের সিনিয়র কাউন্সিলর লিনা খাতুনের কাছে। তিনিও পারিবারিক কলহ বা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ত্রুটিকেই দায়ী করলেন। তবে বললেন, ‘সন্তান হত্যার বিষয়টি আলাদা। এটি একটি মানসিক রোগ। তবে যেসব মা ভুক্তভোগী তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরো প্রকট হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত খোঁটা শুনতে শুনতে এক ধরনের ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে থাকেন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। এরপর আসে সন্তানের প্রশ্ন। মা যেহেতু সন্তানকে জন্ম দেন, দুধপান করান, তাই তাকে নিজের অংশ মনে করেন বেশির ভাগ মা। আবার দেখা যায় নিজের অর্পূণতাগুলো সন্তানের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চান। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারে নারীর অধিকার অনেকাংশে কম থাকায় মায়েরা সন্তানের ওপর অধিকার প্রয়োগ করেন। প্রেসার দেন। এসব থেকেই এক সময় মায়েদের মনে উল্টাপাল্টা চিন্তা গ্রো করে। মা না থাকলে সন্তানকে কে দেখবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে ইত্যাদি চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে। এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক চাপ যদি থাকে তাহলে সমস্যা গভীর হয়। ফলে তিনি হঠকারিতার দিকে এগিয়ে যান। এর সমাধান কী? সমাধানও খুব সহজ করেই বললেন। পরিবারের সবাই মিলে একটি শিশুকে বড় করার দায়িত্ব নিলে, এ সমস্যা অনেকটাই কাটানো সম্ভব।
এ তো গেল দোষারোপের বিষয়। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে টেনশন কি আজকাল একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে মায়েদের? যুগের পটপরির্বতনে বেড়েছে সিঙ্গেল ফ্যামিলির সংখ্যা। বেড়েছে শিক্ষিত ও কর্মজীবী মায়েদের সংখ্যাও। এ মায়েরা পৃথিবীকে অনেক বেশি দেখেছেন, জেনেছেন। তবুও মায়েদের টেনশন কমছে না, বরং বাড়ছে। কেন? যুগের চাহিদাই কি এর মূল কারণ?
আগে বাবা-মায়েরা ছেলের একটা চাকরি আর মেয়েদের সৎ পাত্রস্থ করতে পারলেই নিশ্চিন্ত হতেন। কিন্তু এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বায়নের যুগ। এ যুগে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাই মুখ্য নয়, আরো অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। রাজধানীর কয়েকটি স্কুল ঘুরে এ রকম আভাসই পাওয়া গেল। মিরপুরের একটি নামকরা স্কুলের অভিভাবক রুমে মেজো ছেলের জন্য অপেক্ষারত মিসেস তামান্না। তিনটি সন্তান তার। দেখেই বোঝা গেল খুব তাড়ায় আছেন। কিসের তাড়া জানতে চাইলে বললেন, একে কোচিংয়ে দিয়ে বড় ছেলেকে ড্রয়িং কাসে দিতে যাবেন। তিনি পুরোদস্তুর গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও অবসর মেলে না। কারণ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সন্তানদের নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয়। তিন সন্তানের স্কুল, কোচিং, ড্রয়িং কাস, মেয়ের নাচের কাস ইত্যাদি। এ রকম প্রায় সব অভিভাবকেরই ব্যস্ততা রয়েছে।
আগে তো এত কোচিং-প্রাইভেট লাগেনি পরীক্ষায় পাস করতে। এখন কেন লাগছে? প্রত্যেকেই উত্তর দিলেন, স্কুলগুলোর সিলেবাস অনেক বড়, অনেক কঠিন। আর প্রতি কাসেই প্রায় আশি, নব্বইজন শিশু। সিলেবাস শেষ করতে হলে এবং বুঝতে হলে এক্সট্রা কোচিং লাগেই। এ ছাড়া বর্তমানে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই সন্তানকে বিভিন্ন এক্সট্রা যোগ্যতায় যোগ্য করে তুলছেন, যাতে ভবিষ্যতে এক দিক না হলেও আরেক দিকে ক্যারিয়ার গড়তে পারে। এই আরেকদিকটাও প্রতিযোগীতাহীন নয় মোটেও। আমাদের বাঙালি সমাজের আগের শান্ত নির্মল আবহটি হারিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিকতায় দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়াতে। এ অবস্থা কি প্রভাব ফেলছে আমাদের জীবনে? সমাজবিজ্ঞানী রাশেদা ইরশাদ বললেন, ‘এর প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মানুষের সন্তুষ্টিবোধ কমে যাচ্ছে। উচ্চাকাক্সার ফলে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে, যা মানুষকে হতাশার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। কারণ সবাই সব কিছু হতে পারবে না। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন ধারণাই প্রচলিত হয়ে এসেছে যে, সবাইকেই ফার্স্টকাস অফিসার বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। অন্য কাজকে বা কম বেতনের কাজকে ছোট মনে করা হয়। আবার লোকে কী বলবে, ছোট হয়ে যাচ্ছি কি না এজাতীয় চিন্তাভাবনার ফলেই আজকের এমন দশা।’
তার বক্তব্যের যথার্থতা পাওয়া গেল শিশুদের সাথে কথা বলে। প্রত্যেকেই বলল, মায়ের শাসনের কথা। এ প্লাস গ্রেড না পেলে আম্মু বকবে। কিংবা অমুকের থেকে নম্বর বেশি না পেলে মারবে। এই ‘অমুকটা কে’ জানতে চাইলে জানা গেল প্রত্যেকের অমুকটাই হয় তার কাসফ্রেন্ড, নয়তো কাজিন, নয় প্রতিবেশী। অর্থাৎ শিশুদের মনে মায়েরা নিজের অজান্তেই প্রতিযোগিতার বীজ বপন করে দিচ্ছেন। লিনা খাতুনের মতে, এর প্রভাব খুব গভীর ও ভয়াবহ হয়। আজকাল পারস্পরিক যে অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে, সহমর্মিতার অভাব দেখা যাচ্ছে, তার সূত্রপাত কিন্তু এখান থেকেই। ছোটবেলা থেকেই সে এটা ভেবে বড় হচ্ছে যে, অমুক অমুক তার প্রতিযোগী। ফলে তার প্রতি সহানুভূতির চেয়ে হিংসা জন্ম নেয়। দিনে দিনে তা বাড়ে। শিশু বয়সের গেঁথে যাওয়া বিষয় থেকে সে বাইরে বের হতে পারে না।
এর সমাধান কী বা বিকল্প পথটাই বা কী হতে পারে? অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদের মতে, অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতা গ্রো করতে হবে এবং একই সাথে অপরকে হেয় করার যে একটি প্রবণতা সেটি দূর করতে হবে। যাতে করে, যে অনেক বড় কিছু হতে পারল না সে নিজেকে ছোট বা অপাঙ্ক্তেয় মনে না করে। শিক্ষাব্যবস্থারও পরির্বতন দরকার। যাতে সব শিশু নিজের আনন্দে নিজের আগ্রহ অনুযায়ী পড়াশোনা করতে পারে। তাহলে তাদের ওপর বাবা-মায়ের প্রেসারও কমে আসবে।