গাছের পরিচয়ে গ্রাম
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
নাটোর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার খোলাবাড়িয়া। গ্রামের পথের দুই ধার ও জমিতে গাছ আর গাছ। যেনতেন গাছ নয়, অনেক জটিল রোগ সারাতে পারে এরা। গাছের পরিচয়েই খোলাবাড়িয়াকে ডাকা হয় ‘ঔষধি গ্রাম’। ঘুরে এসে জানালেন রেজাউল করিম রেজা ।
লক্ষ্মীপুর, খোলাবাড়িয়া হয়ে কাঁঠালবাড়িয়া—পথের দুই ধার ভরা সবুজ। ঔষধি গাছই বেশি। শুধু ক্ষেতেই নয়, বাড়ির খালি জায়গায়ও রয়েছে ছোট বড় বাগান। ঘৃত কমল,
স্বর্ণলতা, উলটকম্বল, ঘৃতকুমারী, শতমূল, মিছরিদানা, তুলসী, থানকুচি, জার্মানিলতা, হরীতকী, বহেরা, আমলকী, চিরতা, তালমাখনা, তেলাকুচি, বাসক, অশ্বগন্ধা, লজ্জাবতী সাদা-লাল, হস্তিগন্ধা, তেজবল, দুধরাজ, নাগেশ্বর, আমরুল, ঘোড়াচাণ্ডাল, কালো ধুতরা, ঘিয়া বাবলা, লতা কস্তুরী, আলকুচি, অপরিচিতা, পাথরকুচি, ভুঁইকুমরোসহ নানা জাতের গাছ। পথে খোলাবাড়িয়ার জয়নাল আবেদীনের কাছ থেকে জানলাম, খোলাবাড়িয়া, খামারপাড়া, আমিরগঞ্জ, হিসুলী, কাঁঠালবাড়িয়া, এতিম মোড়, চৌরী, দক্ষিণপুর, মোল্লার মোড়, বড়বড়িয়া, ইব্রাহীমপুরের প্রায় ৮০০ চাষি ঔষধি গাছ চাষের ওপর নির্ভরশীল।
জমিতে কাজ করছিলেন আইয়ুব আলী। জানালেন, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসব গাছ কিনে নেয়। এলাকার কেউ কেউ আবার ফেরি করে বিক্রি করে। আমিরগঞ্জ বাজারে ঔষধি গাছ প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি শুরু হয়েছে। গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি দোকান। সেখানে ঔষধি গাছ থেকে গুঁড়া তৈরি করে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলো পাঠানোও হয়। চাষিরাও লাভের মুখ দেখছে। তারা এসব গাছের চাষ করছে কয়েক দশক। প্রায় ৪০ বছর আগে এই অঞ্চলে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন আফাজ উদ্দিন। পাশাপাশি কবিরাজি চিকিত্সাও শুরু করেন তিনি। এলাকায় সবাই তাঁকে বলে আফাজ পাগলা। নিজে চাষ করে থেমে থাকেননি, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেন। প্রথমে কেউ গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন এটি লাভজনক। আলাপকালে আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমার কঠিন ব্যাধি হইছিল। দেখা গেল কোনো চিকিত্সাপত্রতে কাজ হইতাছে না। তহন আমার নানি কিছু গাছ-গাছড়ার চিকিত্সা করত। নানির চিকিত্সায় ভালো হইলাম। তহন থাইক্যা গাছের প্রতি আমার একটা টান সৃষ্টি হইল। নানির কাছ থাইক্যা গাছের গুণাগুণ শিখলাম। এহন মানুষের চিকিত্সা করাই আর ওষুধের গাছ লাগাইতে পারামর্শ দিই। দূর-দূরান্ত থাইক্যা লোকজন আসে চিকিত্সা নিতে। আমার দেহাদেহি আশপাশের গেরামের লোকজন ওষুধের গাছের চাষ করতাছে। আমার পরামর্শ হইল, বাড়ির আশপাশে ওষুধের গাছ লাগান।’
আফাজ উদ্দিনের বয়স অনেক। তার পরও থেমে নেই ঔষধি চাষের উত্সাহ। বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বিনা মূল্যে গাছের চারা দিয়ে বেড়ান তিনি। পুরো নাটোর একদিন ঔষধি জেলা হিসেবে পরিচিত হবে—এই তাঁর স্বপ্ন। পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি ২০০৯ সালে ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’।
ঔষধি চাষ সম্প্রসারণ ও বাজারজাত করতে চাষি ও ব্যবসায়ীরা করেছেন ‘নাটোর ঔষধি গ্রাম সংগঠন’। এই সংগঠনের মোতালেব হোসেন বলেন, ‘দেশে অনেক আয়ুর্বেদিক কম্পানি রয়েছে। তারা যদি এখান থেকে ভেষজ উপাদানগুলো সংগ্রহ করত তাহলে চাষিদের ভাগ্যের পরিবর্তন হতো। কিন্তু সেগুলো তারা ভারত থেকে আমদানি করে।’ কেন তারা এখানে আসে না, জানালেন আমিরগঞ্জের চাষি রজব আলী। তিনি বলেন, ‘এক বিঘা ঘৃতকুমারী চাষ করতে প্রথম বছর খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। পরের বছর ৮০ থেকে এক লাখ টাকা। ফরিয়াদের কাছে বিক্রি করে পাওয়া যায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এপি বা হামদর্দের প্রতিনিধিরা নাটোরে এসে ৩০০ গ্রাম ঘৃতকুমারীর দাম ধরে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। অথচ ফরিয়াদের কাছে বিক্রি হয় চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এ কারণে আয়ুর্বেদিক কম্পানিগুলোর কাছে ঔষধ বিক্রি করে আমাদের লাভ হয় না।’