সাক্ষাৎকার: প্রার্থীর ব্যাংকিং জ্ঞান থাকা আবশ্যক
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
মো. আবদুস সালাম জনতা ব্যাংক লিমিটেডের সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর জনতা ব্যাংকে যোগদানের আগে তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে গ্রাজুয়েশন ও পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেন। তিনি ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশের একজন ফেলো (এফসিএ)। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে তার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু। জনতা ব্যাংকের এমডি পদে যোগদানের আগে আবদুস সালাম অগ্রণী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও কর্মসংস্থান ব্যাংকে উচ্চ পদে আসীন ছিলেন।
ব্যাংকে চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়ে কী কী বিষয় দেখেন নিয়োগকর্তারা? নিয়োগ প্রক্রিয়ার এমন নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
: ব্যাংকে নিয়োগে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়?
আবদুস সালাম : ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের অনেকগুলো দিক বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। আবেদনকারীদের প্রেজেনটেশন স্কিল তথা আর্ট অব প্রেজেনটেশন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তার বিষয়গত জ্ঞান কতটা গভীব তা যাচাই করা হয়ে থাকে। প্রার্থীর স্মার্টনেসের পাশাপাশি প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব ও পারিবারিক পটভূমি বিবেচনায় আনা হয়। আত্মবিশ্বাস থাকা চাই। এছাড়া প্রার্থীর কমিউনিকেশন স্কিল, ইংরেজি দক্ষতা, কম্পিউটারে পারদর্শিতা, সৃজনশীলতা, দায়িত্ববোধ, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা সম্পর্কে ভাবনাগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্য করা হয়।
: ব্যাংকে চাকরি প্রত্যাশীরা কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবেন?
আবদুস সালাম : ব্যাংকসহ অন্যান্য যে কোনো চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেই আবেদনকারীদের সাবজেক্টটিভ নলেজ কতটা আছে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তাই যে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীকেই অধ্যয়নকৃত বিষয়ের জ্ঞানের গভীরতা অর্জন করতে হবে। যে কোনো বিষয়ে তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ব্যাংকে চাকরিতে নিয়োগে প্রার্থীকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও দেশীয় অর্থনীতি নিয়ে সাধারণত প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। তাই অর্থনৈতিক সূচক, অর্থনৈতিক সমীক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। প্রার্থীর কিছুটা হলেও ব্যাংকিং জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এছাড়া সাধারণ জ্ঞান বিশেষ করে সাম্প্রতিক ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের তথ্য জানতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত এ ধরনের প্রশ্নও করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে অর্থনীতি সম্পর্কে তার ধারণা-ভাবনা বিচারে নেয়া হয়। নিয়োগ পেলে কীভাবে কাজ করবেন, কেন ব্যাংকে চাকরি করতে চান- এ ধরনের প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। তাই এসব বিষয়ে প্রার্থীকে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।
: যারা ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাদের চাকরি প্রস্তুতি কখন থেকে নেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আবদুস সালাম : চাকরির প্রস্তুতির জন্য কোনো সিলেবাস নেই। এজন্য ব্যাপক পড়াশোনা থাকা চাই। অনেকে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকেই একটু একটু করে চাকরি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। তবে এইম বা লক্ষ্যটা আগেই স্থির করা উচিত এবং সে অনুযায়ী ইফোর্ট দেয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই প্রেজেনটেশনের জড়তা কাটিয়ে তুলতে পরামর্শ দেব। ভালো ইংরেজি জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই কমিউনিকেশন স্কিল অর্জন করতে হবে। এছাড়া বর্তমানের ডিজিটাল বিশ্বে প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকলে দুনিয়া থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে। শিক্ষাজীবনেই ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশনে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যে বিষয়ের ছাত্রই হোক না কেন তাকে একাডেমিক পড়ালেখায় সিরিয়াস হতে হবে। যাদের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী তারা গ্রাজুয়েশনের পরই চাকরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
: ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিবিএ, এমবিএর গ্রাজুয়েটরা কী অগ্রাধিকার পায়?
আবদুস সালাম : কিছু কিছু বিষয়ে এমবিএ গ্রাজুয়েটরা অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীর চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকেন। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস, ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড মার্চেন্ট ব্যাংকিং, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড, ম্যানেজারিয়াল ইকোনমিক্স, বাজেট অ্যানালাইসিস, পুঁজিবাজার এসব বিষয়ে এমবিএ ও অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জানাশোনা ভালো। তাই ব্যাংকের কোনো কোনো বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সাধারণ ব্যাংকিংসহ বেশিরভাগ নিয়োগের ক্ষেত্রেই অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ থাকে।
: কর্মস্থলে পারফরমেন্সে বিবিএ-অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের তুলনায় অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের গ্রাজুয়েটরা পিছিয়ে পড়ে কি?
আবদুস সালাম : সাধারণত নিয়োগের পরপরই প্রত্যেক কর্মকর্তাকে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করানো হয়ে থাকে। যেখানে ব্যাংকিং সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে কর্মীকে গড়ে তোলা হয়। তাই সমাজবিজ্ঞান, কলা, সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের গ্রাজুয়েটরাও ব্যাংকিংয়ে ভালো করে। সর্বোপরি আত্মপ্রত্যয়ী, মেধাবী ও মনোযোগী কর্মী যে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ডেরই হোক না কেন সাধারণত ভালো করে থাকে।
: ইন্টার্নশিপ কি চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থীকে এগিয়ে রাখে?
আবদুস সালাম : হ্যাঁ, যারা ব্যাংকে ইন্টার্নশিপ করে থাকে তারা ব্যাংক সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়ে থাকে, যা চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
: ব্যাংকারদের কেউ কেউ এমবিএম, এইচআরএমে প্রফেশনাল ডিগ্রি করে থাকে, এটি কি তাকে কাজের ক্ষেত্রে অ্যাডভান্টেজ এনে দেয়?
আবদুস সালাম : হ্যাঁ, অনেকে চাকরি অবস্থায় ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স, উন্নয়ন অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে থাকে। এ অধ্যয়নের ফলে চাকরি জীবনে ভালো করেন।
: জনতা ব্যাংক বছরে কি পরিমাণ লোকজন নিয়োগ দিয়ে থাকে?
আবদুস সালাম : এখন থেকে সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কর্মী নিয়োগ দেবে ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি। এছাড়া অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী শূন্য পদের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী লোকজন নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে জনতা ব্যাংকের দেশজুড়ে নয়শত-এর অধিক শাখা রয়েছে। গোটা ব্যাংকিং সেক্টরে যত লোকবল কাজ করছে তার প্রায় নয় শতাংশ কর্মসংস্থান জনতা ব্যাংকে।
: চাকরি প্রার্থীরা চাকরি নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত। সে ক্ষেত্রে ব্যাংক জব কতটা সিকিউরড?
আবদুস সালাম : আমি বলব, ব্যাংক চাকরি অনেকটাই নিরাপদ, সেই সঙ্গে রয়েছে সামাজিক মর্যাদা। এখানে কাজের পরিবেশ ভালো। মনোযোগীরা দ্রুতই প্রমোশন পেয়ে থাকে। প্রাইভেট ব্যাংকগুলো কর্মীদের ভালো বেতন দিচ্ছে। নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়ন হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের বেতনও বেড়ে গেছে। এছাড়া চাকরি প্রার্থীরা নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি আরও কিছু আশা করে। বেতন-ভাতার পাশাপাশি ইনসেনটিভ দেয় ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কর্মীদের পেনশন দিয়ে থাকে। যা অবসরের পর কর্মীদের জীবন-যাপনের ব্যয় নির্বাহের নিরাপত্তা দেয়। হাউস বিল্ডিং লোন দেয় ব্যাংক। কর্মীদের বিনা সুদে গাড়ি লোন দিচ্ছে ব্যাংক। সম্প্রতি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করা হয়েছে, যেখানে নারী কর্মীরা তাদের নবজাতকদের রেখে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবেন। সব মিলিয়ে ব্যাংক জব নিরাপদ।
: দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে জনতা ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে?
আবদুস সালাম : দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জনতা ব্যাংকের অবদান কম নয়। দেশের জিডিপিতে সমগ্র ব্যাংক মিলে যে অবদান রাখে তার শতকরা ৭ থেকে ৯ ভাগ অবদান জনতা ব্যাংকের। মোট রেমিট্যান্স আয়ের শতকরা ৯ ভাগের অধিক আসে জনতা ব্যাংক হয়ে, শীর্ষ রেমিট্যান্স আয়ের ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক চতুর্থ। মোট আমদানির শতকরা প্রায় ৫ ভাগ ও রফতানির প্রায় ৮ ভাগ জনতা ব্যাংকের মাধ্যমের হয়ে থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরে যত কর্মসংস্থান তার শতকরা প্রায় ৯ শতাংশ জনতা ব্যাংকে। সারাদেশে জনতা ব্যাংকের ৯শ’রও বেশি শাখার মাধ্যমে গ্রাহকসেবা দিচ্ছে। সব ব্যাংক মিলে যত শাখা আছে তার ১০ ভাগ জনতা ব্যাংকের। এছাড়া ২০১৪ সাল নাগাদ ব্যাংকটির অনলাইন শাখার সংখ্যা ছিল ১৭৪টি। ২০১৫ সালে আরও ৩২৯টি শাখায় অনলাইন সুবিধা চালুর মাধ্যমে বর্তমানে ব্যাংকের ৯০৮টি শাখার মধ্যে ৫০৩টি শাখা অনলাইন সুবিধা চালু করা সম্ভব হয়েছে। এ বছরের জুনের মধ্যে ব্যাংকটির সবগুলো শাখায় অনলাইন সুবিধা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। আর এ সুবিধা চালু হলে ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বল্প সুদের আমানত এবং উন্নত গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধিসহ লোকসানি শাখার সংখ্যা আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।