চাকরির বয়স নিয়ে যত কথা
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
ঢাকা কলেজের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম। ২০১২ সালে তিনি যখন মাস্টার্স শেষ করেন তখন তার বয়স ছিল ২৮ বছরের চেয়ে বেশি। মঞ্জুরুলের ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় রোল নম্বর ছিল ০১৬৪৪৪। তিনি বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। নন-ক্যাডারের তালিকায় তার রোল থাকলেও তিনি কোনো ক্যাডার সার্ভিসের জন্য সুপারিশ পাননি। পরে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে যে কয়জন নন-ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে মঞ্জুরুলের রোল নম্বর ছিল না। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রেও মঞ্জুরুলের একই ঘটনা ঘটে। ওই সময়ও তিনি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ক্যাডার সার্ভিসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হননি। সম্প্রতি ৩৪তম বিসিএস থেকে বেশ কয়েকজনকে নন-ক্যাডারের জন্য সুপারিশ করা হলেও মঞ্জুরুলের রোল নম্বরটি (০৬৩১৩৫) সেখানে নেই। মঞ্জুরুল ভালো চাকরির আশায় ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স করার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। বিসিএস ছাড়া তিনি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তার জায়গা হয়নি। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। ফলে ৩৪তম থেকে নন-ক্যাডারের সুপারিশই তার একমাত্র ভরসা। মঞ্জুরুলের দাবি, চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানো হলে হয়তো তিনি তার যোগ্যতার বলেই পছন্দের ক্যাডার সার্ভিসে যেতে পারতেন। তার দাবি, এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বয়সসীমা কমপক্ষে ৩৫ করা উচিত। মঞ্জুরুলের মতো সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা একাধিক মৌখিক পরীক্ষা দিয়েও সোনার হরিণ নামক সরকারি চাকরি পাচ্ছেন না।
সার্টিফিকেট অর্জনের বয়স
প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তি হওয়ার ন্যূনতম বয়স ৬ বছর করা হয়েছে। ফলে আগে একজন শিক্ষার্থী ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সে এসএসসি পাস করতে পারলেও এখন সেটা ১৬ বছরের আগে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। পরে কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে এইচএসসি পাস করতে একজন শিক্ষার্থীর বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর হয়ে যায়। অপরদিকে স্নাতক (পাসকোর্স) ও সম্মান (অনার্স) উভয় ক্ষেত্রে লেখাপড়ার সময় এক বছর করে বাড়িয়ে যথাক্রমে তিন ও চার বছর করা হয়েছে। এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স/ডিগ্রি ও মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হওয়ার মধ্যবর্তী সময় নষ্ট হয় সব মিলিয়ে প্রায় দুই বছর। প্রচলিত নিয়মানুসারে ২৩ থেকে ২৪ বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সমীকরণটি শুধু কাগজ-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। কারণ বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ২৭/২৮ বছরের আগে শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারেন না। তাছাড়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশন জটের কারণে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভের পর চাকরির জন্য প্রস্তুতির সময়ই পান না। যে কারণে অনেকের ভাগ্যে কোনো চাকরিই জোটে না। সবমিলে দেখা যায় যে, অনেক শিক্ষার্থীর চাকরির বয়স চলে যায় একাডেমিক সার্টিফিকেট অর্জন করতে না করতে।
যাদের কপালে কেবল সার্টিফিকেট জুটেছে
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম তুলে ধরেন তার হতাশার কথা। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতেই বয়স ২৮ বছর পার হয়ে যায়। শফিকুল শিক্ষামন্ত্রণালসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু কপালে চাকরি জোটেনি। বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। সর্বশেষ সরকারি রাজস্ব কর্মকর্তা পদে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। এখানে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি না পেলে সরকারি চাকরি আশা চিরতরে ছেড়ে দিতে হবে। শফিকুল বলেন, পড়াশোনা অবস্থায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। এখন চাকরিও হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জীবনের কোনো মূল্য নেই। শফিকুল বলেন, তার মতো এমন অনেক অসহায় শিক্ষার্থী রয়েছেন। সরকারের উচিত তাদের দিকে নেকনজর দিয়ে বয়স বৃদ্ধি করা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শাহীন ইসলাম ২৮ বছরের চেয়ে বেশি বয়সে একাডেমিক (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) সার্টিফিকেট অর্জন করেন। তাদের বিভাগে ভয়াবহ সেশনজট থাকার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। শাহীন জানান, একাডেমিক পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর যখন দেখলেন চাকরির বয়স প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন তিনি মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েন। তারপরও তীব্র মনোবলের কারণে বেশ কিছু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু কপালে চাকরি জোটেনি। শাহীন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সংসদ সদস্য হতে কিংবা মন্ত্রী হতে কোনো বয়স লাগে না। ৮০ থেকে ৯০ বছর বয়সেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হওয়া যায়। তাহলে আমাদের জন্য এত বাধ্যবাধকতা কেন?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান বলেন, সেশনজটের কারণে তার শিক্ষাজীবন থেকে ৩-৪ বছর চলে গেছে। তিনি ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তবে ক্যাডার সার্ভিসের জন্য সুপারিশ পাননি। সম্প্রতি নন-ক্যাডার থেকে যে সুপারিশ করা হয়েছে সেখানেও তার নাম নেই। অপরদিকে তার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষ হয়েছে গত বছরের এপ্রিলের দিকে। এখন পর্যন্ত তার ভাগ্যে চাকরি না জোটায় বেকার জীবন-যাপন করছেন। সাইদুরের বক্তব্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই দু-তিন বছরের সেশনজট। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাস করেছে তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। যদি আমি আরও কিছু সময় বেশি পেতাম তাহলে আমার মেধাটা প্রকাশ করার সুযোগ পেতাম। সার্টিফিকেট অর্জন করতে আমার বয়স শেষ হয়ে গেছে। তাই আমি চাকরির সুযোগ চাই।
বয়স বেড়েছে ডাক্তার ও নার্সদের
ডাক্তারদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর। এখানে তাদের দু’বছর বেশি সুযোগ দেয়ার পেছনে যুক্তি হল তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি সময় অধ্যয়ন করেন। পরে সাধারণদের স্নাতক ও সম্মান উভয় পর্যায়ে সময় ১ বছর বৃদ্ধি করা হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আনুপাতিক হারে বাড়ানো হয়নি। অপরদিকে নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৬ বছরে উন্নীত করা হয়েছে।
সময়মতো সার্কুলার দেয়া হয় না
চাকরি প্রত্যাশী একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে যে, সময়মতো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। ফলে তারা অনেকেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। উদারহণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ২৭ থেকে ২৮তম বিসিএস পরীক্ষার মধ্যে ৩ বছরের গ্যাপ তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে অনেক শিক্ষার্থীকে বেকার থাকতে হতো না। তাই তাদের বয়স বাড়ানো হলে তারা শেষ চেষ্টার সুযোগ পাবেন।
বেসরকারিতেও বয়স নির্ধারিত
সরকারি নিয়ম অনুসরণ করার ফলে বেসরকারি ব্যাংকসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে জনবল (অভিজ্ঞতা ছাড়া) নিয়োগ দেয় না। ফলে বয়সসীমার ফাঁদে পড়ে শিক্ষিত যুবকরাও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান না। এ ব্যাপারে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী টিটু মোদক বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আজকাল চাকরিতে বয়সসীমা উল্লেখ করে দিচ্ছে। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি বঞ্চিতরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও চাকরির আবেদন করতে পারেন না। যে কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও চাকরির সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
দাবি উঠেছিল সংসদেও
সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ পর্যন্ত করার দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদেও। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সংসদের নবম অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে জিয়াউল হক বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের প্রতি দলমত সব সচেতন মানুষের সমর্থন রয়েছে। শাহবাগে এসব আন্দোলনকারীদের ব্যানারে বড় করে লেখা ছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বয়স বাড়ান, জীবন বাঁচান’। পুলিশি হস্তক্ষেপে আন্দোলনকারী নেতাদের আটক করে অবরোধ থামিয়ে দিলেও বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, সেশনজট, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে অনেক চাকরি প্রার্থীর বয়স ৩০ পেরিয়ে যায়। এ কারণে তারা সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। অপর দিকে অনেক প্রতিভাবান ছেলে শুধু বয়সের হেরফেরের কারণে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। ফলে রাষ্ট্রও বঞ্চিত হয় তাদের সেবা থেকে। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। জিয়াউল হক বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়স আমাদের চেয়ে বেশি হলেও আমাদের দেশে কম। এটি একটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা। এর ফলে শিক্ষিত বেকারে দেশে ছেয়ে গেছে। অপর দিকে সব সরকারি দফতরে শূন্য পদের ছড়াছড়ি। আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন, চাকরি থেকে অবসরের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। অথচ চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো হবে না কেন? চাকরিতে ঢোকার বয়ঃসীমা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।’
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দাবি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ সংগঠনের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শাহীন সাধারণ শিক্ষার্থীদের বয়স বাড়ানোর দাবি সম্পূর্ণ যৌক্তিক আখ্যায়িত করেছেন। এই দুই নেতা বলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা প্রয়োজন। সংগঠনের এই দুই শীর্ষ নেতা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও বয়স বাড়ানোর দাবি জানান।