ভালো বক্তা হওয়ার গল্প
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
এক দেশে ছিল এক রাজা, একদিন রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজ্যের ভার ছেলের ওপর অর্পণ করবেন। ছেলেকে নিয়ে পরের দিন রাজসভায় উপস্থিত হলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর রাজ্যের প্রজা ও মন্ত্রীদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার জন্য রাজপুত্রকে অনুরোধ করা হল। কথা বলতে গিয়ে রাজপুত্রের হাত-পা কাপাকাপি। মুখ থেকে কথা বের হয় না।
রাজা মশাই ভাবলেন, হয়তো গলায় কোনো সমস্যা। সঙ্গে সঙ্গে লবণ-পানি দিয়ে রাজপুত্রকে কুলি করালেন। এরপর আবার রাজপুত্র জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। রাজপুত্র এবার ঘেমে যাচ্ছেন। প্রহরীরা পাখা নিয়ে বাতাস করতে দাঁড়িয়ে গেল রাজপুত্রের পিছনে। রাজপুত্র ভয়ে ডানে-বামে, উপরে-নিচে তাকিয়ে আস্তে করে সেখানে ফিট খেয়ে পড়ে গেলেন। রাজপুত্র কিভাবে রাজ্যের শাসনভার নিবেন? কিভাবে শিখবেন পাবলিক স্পিকিং?
রাজামশাই খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। রাজ্যজুড়ে রটে গেল, রাজপুত্র পাবলিক স্পিকিং পারে না। মন্ত্রী, উজির, সৈন্য সবাই মিলে খুঁজে রাজ্যের সেরা শিক্ষককে নিয়ে এলেন রাজপ্রাসাদে। রাজামশাই তাকে দিলেন রাজপুত্রকে পাবলিক স্পিকিং শেখানোর ভার। যদি সে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার গর্দান যাবে।
শিক্ষককে নিয়ে যাওয়া হল রাজপুত্রের কাছে। রাজপুত্র তখনও ভয়ে কাতর, দুর্বল। আয়া তাকে ডিম সিদ্ধ খাওয়াচ্ছে। শিক্ষক নিজের পরিচয় দিলেন। একটি ডিম তিনি নিলেন ও সেটি বাইরে থেকে ভেঙে খোসা ছাড়াতে লাগলেন। রাজপুত্রকে বললেন, ‘দেখেছেন রাজপুত্র, এটি একটি সামান্য ডিম। কিন্তু একে আপনি যদি বাইরে থেকে ভাঙেন, তাহলে একটি প্রাণের মৃত্যু ঘটবে, কিন্তু এটি যখন ভিতর থেকে ফাটবে তখন নতুন প্রাণের জন্ম হবে। আপনি যদি ভিতর থেকে নিজেকে জাগিয়ে তুলতে না পারেন, তাহলে আপনার ভিতরের সেই নতুন আপনি, আত্মবিশ্বাসী আপনাকে কোনোদিনই আপনি খুঁজে পাবেন না।’
রাজপুত্রকে এভাবে কেউ কোনোদিন বলেনি। সে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ভয় করে সবার সামনে কথা বলতে, লোকে কি না কি ভাবে?’ শিক্ষক বললেন, ‘লোকে কি ভাবল তা যদি আপনিই ভাবেন, তাহলে লোকে ভাববে কি? লোকে আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই বলবে। অনেক আজেবাজে কথা বলতে পারে। যে কাজ করে তাকে নিয়েই কিন্তু আলোচনা হয়, সমালোচনা হয়। তাছাড়া সমালোচনার চেয়ে বড় ব্রান্ডিং দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই।’
রাজপুত্র বললেন, ‘আমার যদি ভুল হয়?’ শিক্ষক উত্তর দিলেন, ‘যে কাজ করে ভুলতো তারই হয়, কাজ যে করেই না, তার তো ভুলই হয় না, লক্ষ্য করেছেন কি কখনও?’
রাজপুত্র বললেন, ‘এ তো অনেক সময়ের ব্যাপার?’ শিক্ষক বললেন, ‘হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিতে গেলে, আপনাকে প্রথম পা তো ফেলতেই হবে, নয়তো এগোবেন কিভাবে?’
রাজপুত্র বললেন, ‘কিভাবে বুঝব আমি ঠিক করছি না ভুল করছি?’ শিক্ষক একটি আয়না বের করলেন এবার। আয়নাটি রাজপুত্রের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন, আয়নায় নিজেকে দেখুন, নিজের বাচনভঙ্গী দেখুন, আপনার বাবা রাজামশাই, কত বড় মানুষ, তার কথা রাজ্যভরা লোক মুগ্ধ হয়ে শোনেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি তার যোগ্য উত্তরসূরি হবেন।’
রাজপুত্র বললেন, ‘আয়নাতে তো নিজেকে দেখা যায়, কিন্তু মানুষের সামনে গেলে আমি কিভাবে কি করব?’ শিক্ষক বললেন, ‘এ ক্ষেত্রে আপনাকে আরও মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, জনতার সামনে বক্তব্য দেয়ার আগে আপনাকে আপনার অধীনস্থদের মাঝে বক্তব্য দেয়া শিখতে হবে। আপনাকে সৈন্য, আয়া, বুয়া, রক্ষী এদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এদের খোঁজ-খবর নিন, এদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলুন। কার ছেলে-মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে না খোঁজ নিন। কাদের পরিবারে কি হচ্ছে জানুন। তাদের শিক্ষার গুরুত্বটা বুঝান, এতে আপনার পাবলিক স্পিকিং-এর প্রাথমিক ঝালাইটা হয়ে যাবে।’
রাজপুত্র বললেন, ‘ওরা কি আমার কথা বুঝবে?’ শিক্ষক বললেন, ‘হুজুর আপনাকে সহজ সহজ গল্প ব্যবহার করতে হবে তাদের বোঝানোর জন্য, এতে তারা আপনাকে সহজে গ্রহণ করবে।’
রাজপুত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেটা কিরকম?’ শিক্ষক বললেন, ‘ধরুন, রাজসভায় একজন মন্ত্রী সব সময় মানসিক অস্থিরতায় ভুগেন এই ভেবে যে, তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে আপনাকে তাকে বুঝাতে হবে যে, আপনার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যথার্থ। কিন্তু আপনি সেটা কিভাবে করবেন? আপনি কি বলবেন, না মন্ত্রী মশাই, আপনি ঠিক বলছেন না, আপনি আসলে কাজ করেন না, তাই মূল্যায়ন হয় না। একটু ভেবে দেখুন, এভাবে যদি আপনি তাকে তিরস্কার করেন, তাহলে সে কিন্তু মনে মনে আরও হতাশ হয়ে পড়বে।’
রাজপুত্র কৌতূহলী হয়ে বললেন, ‘সে কি? তাহলে, আমি কিভাবে বুঝাব তাকে?’ শিক্ষক বললেন, ‘গল্পের দ্বারা, আপনি হয়তো একটি প্রতীকী গল্প বলতে পারেন। গল্পটা হতে পারে এরকম যে, এক লোক সারাক্ষণ শুধু অভিযোগ করতো, কেউ তার যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করে না। একদিন একজন জ্ঞানী লোক বিষয়টি সম্পর্কে জানলেন এবং লোকটির কাছে এলেন। তিনি মাটি থেকে একটি পাথর তুলে একটি পাথরের স্তূপে ফেলে দিলেন। তারপর ওই লোককে বললেন : ‘পাথরের স্তূপ থেকে আমার ফেলে দেয়া পাথরটি খুঁজে বের কর।’ লোকটি পাথর খুঁজে বের করার জন্য অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু হাজার হাজার পাথর থেকে ওই নির্দিষ্ট পাথরটি আলাদা করতে পারল না। এরপর জ্ঞানী লোকটি এক টুকরা স্বর্ণ পাথরের স্তূপে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন : ‘এবার স্বর্ণের টুকরাটি খুঁজে বের কর।’ লোকটি অনায়াসে স্বর্ণের টুকরাটি পাথরগুলো থেকে আলাদা করে ফেলেল।
এবার জ্ঞানী লোকটি বললেন, ‘দেখ, তুমি যখন স্বর্ণের মতো মূল্যবান হবে, তখন লোকে তোমাকে সহজেই চিনে নেবে এবং তোমার মূল্যায়ন করবে। কিন্তু ‘পাথর’ হয়ে তুমি কখনোই স্বর্ণের মতো গুরুত্ব পাবে না। যদি তুমি অন্যের কাছে মূল্য পেতে চাও, অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাও, তবে নিজেকে সেভাবে গড়ে তোল। অযথা অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই।’ অসংখ্য পাথরের মাঝে স্বর্ণের মতো হলে তোমাকে চেনা যাবে, পাথরের মতো হলে নয়। আপনি যদি এরকম একটি সহজ গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেন, তাহলে শ্রোতার জন্যও বুঝতে সহজ হবে।
রাজপুত্র খুশিতে বলে উঠলেন, ‘তাহলে আমি এবার সব মুখস্থ করে ফেলব।’ শিক্ষক হাসি দিয়ে বললেন, ‘ঠিক মুখস্থ করে আপনি পারবেন না। আপনাকে মানুষের চাহিদা বুঝতে হবে, মানুষ আপনার কথা বুঝতে পারছে কি না বুঝতে হবে। সেনাপতির সঙ্গে যখন কথা বলবেন তখন রণকৌশল নিয়ে কথা বলবেন, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের কোষাগার নিয়ে আলাপ করতে হতে পারে, এভাবে আপনি কত জনের জন্য মুখস্থ করবেন?’
রাজপুত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর জন্য আমি কি করব?’ শিক্ষক জানালেন, ‘আপনাকে অনেক বই পড়তে হবে, অন্যরা কিভাবে কথা বলে খেয়াল করতে হবে। আপনাকে শ্রোতার বয়স জানতে হবে। তারা আপনার কথা বুঝছে কি না সেটা বুঝতে হবে।’
রাজপুত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেটা কিভাবে বুঝব?’ শিক্ষক বললেন, ‘আপনাকে শ্রোতার মতামত নিতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। নিজেকে আপডেট রাখতে হবে।’
রাজপুত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কিছু?’ শিক্ষক বললেন, ‘জি, আরও দুইটি ব্যাপার আছে, তা হচ্ছে আপনাকে শ্রোতার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে, শ্রোতার চোখে চোখ রাখতে হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে- তাদের হাসাতে হবে। তাদের কাঁদাতে হবে। ঠিক এরপর আপনি কি নিয়ে কথা বলবেন, তা যেন তারা না বুঝতে পারে। এতে করে তাদের মধ্যে আপনাকে শোনার কৌতুহল থাকবে।’
রাজপুত্র বললেন, ‘কিন্তু এতকিছু কি আমি একা করতে পারব? কিভাবে শুরু করব?’ শিক্ষক বললেন, ‘আজই নিজের ভিতরের জড়তাগুলো ভেঙে ফেলুন, শুরু করুন কথা বলা, শুরু করুন, আয়াকে দিয়ে। দেখবেন খুব দ্রুত আপনি ভালো করছেন। আর তাছাড়া আমি তো আছিই। আমি আপনাকে সাহায্য করছি। আপনার যে কোনো ভুল আমি শুধরে দেব।’
এভাবে ওই দিন থেকে রাজপুত্রের মধ্যে পরিবর্তন আসে। তিনি ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে মিশতে শুরু করেন, কথা বলতে শুরু করেন, আস্তে আস্তে মাত্র দুই মাসে মাথায় তার ভয় চলে যায়। এরপর তিনি আরও পড়াশোনা শুরু করেন, মন্ত্রী, উজির-নাজিরদের সঙ্গে বৈঠকগুলো তিনিই পরিচালনা শুরু করেন। রাজপুত্র এখন শিক্ষকের কথা মতো তিনি সদাই হাস্যোজ্জ্বল থাকেন। তাকে দেখেই সবাই পজিটিভ এনার্জি পেতে থাকে।
মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তার মাঝে বিরাট পরিবর্তন আসে। শিক্ষক রাজাকে জানান, তার দায়িত্ব শেষ। রাজপুত্র এখন সিংহাসনে বসার উপযুক্ত, তিনি সব কিছু সামলাতে পারেন, সবার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তার ভিতর কোনো জড়তা নেই। রাজা শিক্ষককে উপযুক্ত পুরস্কার দেন, পুনরায় রাজ্যজুড়ে ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। সেবার রাজপুত্রের আর কোনো অসুবিধা হয়নি সবার সামনে কথা বলতে। সেই রাজপুত্রই আজকের নতুন মহারাজ।