- ক্যারিয়ার ডেস্ক
বংশপরম্পরায় বাদ্যযন্ত্র বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘নবাব এন্ড কোং’ প্রায় ৭৬ বছর ধরে টিকে আছে। সেই সুবাদে এ প্রতিষ্ঠানের ভান্ডারে যোগ হয়েছে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অনেক বাদ্যযন্ত্র। চলমান বাদ্যযন্ত্র তো আছেই। কোনোটি প্রায় শতবর্ষের পুরোনো। কোনোটি বরেণ্য সংগীতজ্ঞের স্মৃতি ধরে রেখেছে। নিজস্ব সংস্কৃতির ধারকবাহক তো আছেই।
ময়মনসিংহ শহরের বড় বাজারে এই দোকানের অবস্থান। রেজাউল করিম এর স্বত্বাধিকারী। একই জায়গায় আরও বেশ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বিক্রির দোকান আছে। তবে রেজাউল করিমের দোকানটি এখন আর শুধু দোকান নয়, এটি পরিপূর্ণ একটি ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। দোকানের সঙ্গে লাগোয়া একটি ঘরে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র স্তূপ করে রাখা। এগুলো সংগ্রহের জন্য রেজাউল করিম নিজস্ব জায়গায় একটি ব্যক্তিগত জাদুঘর তৈরির স্বপ্ন দেখছেন। বলা যায়, স্বপ্ন পূরণে একধাপ অগ্রসর হয়েছেন। চলতি বছর ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হকের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, রেজাউল করিমের ‘ময়মনসিংহ এশিয়ান সংগীত জাদুঘর’ করার ক্ষেত্রে পৌরসভার কোনো আপত্তি নেই। জেলা প্রশাসক বরাবরও চিঠি লিখেছেন রেজাউল করিম। তবে তার উত্তর পাননি এখনো।
১ আগস্ট কথা হয় রেজাউল করিমের সঙ্গে। একতারা, দোতারা, সারিন্দা, সারেঙ্গী, আনন্দ লহরি… চারপাশে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র। দুপুরবেলা ক্রেতা সামলাতে সামলাতেই কথা বললেন তিনি।
শখের বশেই রেজাউল করিম বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করা শুরু করেন। নবাব আলী ছিলেন রেজাউলের দাদা। ১৯৪৪ সালে দাদা ব্যবসা শুরু করেন। সেই সময় শহরে এটি ছিল দ্বিতীয় দোকান। প্রথম দোকান ‘সুরেন অ্যান্ড কোম্পানি’। পরে কোম্পানির মালিক ভারতে চলে যান। যাওয়ার সময় সেতার, এসরাজসহ বিভিন্ন যন্ত্রই দিয়ে যান ‘নবাব এন্ড কোং’কে। রেজাউলের দাদার পর বাবা জালাল উদ্দিন ব্যবসার হাল ধরেন। ২০০৬ সালে দায়িত্ব নেন রেজাউল। এর আগে থেকেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ছিল তাঁর। রেজাউলের নিজ সংগ্রহের পাশাপাশি বংশপরম্পরায় দোকানে যোগ হতে থাকে একের পর এক বাদ্যযন্ত্র। সেতার আছে পাঁচ রকমের। গিটারই আছে ৫০ রকমের। গিটারের পাশে নতুন করে ১০টি দোতারা বানিয়ে রাখা হয়েছে। রেজাউল করিম বাদ্যযন্ত্রের ভান্ডারে ধুলার আস্তরণ থেকে বের করলেন ২৫ বছর আগে সংগ্রহ করা একটি সরোদ। জানালেন, যন্ত্রটির বয়স কম করে হলেও ৬০ বছর হবে। ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা দামের চামড়া ছিঁড়ে যাওয়া একটি এসরাজ দেখিয়ে জানালেন, একজন ওস্তাদ মারা যাওয়ার আগে তাঁকে দিয়ে গেছেন। এসরাজে হাতির দাঁতের সোয়ারি লাগানো। অনেক সময় বাদ্যযন্ত্রের কদর বুঝতে না পেরেও অনেকে তা বিক্রি করে দিয়েছেন, তারও বেশ কয়েকটি নমুনা আছে। গ্রামের কোনো কারিগরের তৈরি বীণা সরাজ, ৮০ থেকে ৯০ বছরের পুরোনো মিষ্টিকুমড়া দিয়ে বানানো তানপুরাসহ বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে বললেন, সব বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখলে তা দেখতে কম করে হলেও ৪০ মিনিট সময় লাগবে। রেজাউল করিমের দোকানে ১৭ জন কারিগর কাজ করছেন।
রেজাউল করিম জানালেন, ঢেম্পারেঙ, বরতাল, চঙ, দভন্ডি, দোতারা, চিকারা, গিনটোঙ, ঘেরা, যোগী সারঙ্গী, হালগি, মুগরবন, পোহল, থিমিলা, শিঙ্গা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বর্তমানে অনেকটা দুর্লভ বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ততযন্ত্র, আনদ্ধ যন্ত্র, শুষির যন্ত্র এবং ঘন যন্ত্রের চার প্রকারের প্রায় ১০০টি লুপ্ত, বিলুপ্তপ্রায় ও চলমান বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ নিয়েই তিনি জাদুঘর তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।
রেজাউল করিম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কিছুটা গবেষণাও করছেন। হারিয়ে যাচ্ছে যে যন্ত্রগুলো, আধুনিক কারিগরদের দিয়ে ওই যন্ত্রের আদলে নতুন করে আবার বাদ্যযন্ত্র তৈরি করছেন। বেশির ভাগ পুরোনোটার মতোই কাজ দিচ্ছে বলে তাঁর দাবি। বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি গানের বইসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসও তাঁর দোকানে রাখা। যার যেটা প্রয়োজন, তা দেখেশুনে নিতে পারছেন।
রেজাউল করিম বলেন, বাদ্যযন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা না বলে বলা যায়, এ যন্ত্রগুলো নতুন প্রজন্মের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারলে কাজ হয়। তরুণ প্রজন্ম স্প্যানিশ গিটার কিনতে পারলে একতারা কেন কিনতে পারবে না? ‘নবাব এন্ড কোং’-এ অনেকেই গিটার কিনতে এসে একতারা, দোতারা, বেহালা, খমকও কিনে নিয়ে যাচ্ছে। হাতের কাছে থাকলেই না তার ব্যবহার বাড়বে।
এ দোকানের বাইরে রেজাউল করিমের পরিচালনায় শিশুকিশোরদের জন্য নোভিস আর্টিস্টিক এডুকেশন সেন্টারে চারুকলা, বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। রেজাউল করিমের সংগ্রহে থাকা বাদ্যযন্ত্রগুলো ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করেছেন।