পড়ার চাপে চিড়েচ্যাপ্টা ?
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
পড়াশোনা সহজ নয়। এর অনেক ভার। আর ভার মানেই চাপ কিছুটা লাগবেই। সেই চাপ মোকাবিলা করতে না জানলে পড়তে হবে ঘোর বিপদে।
আবদুল্লাহ আল মামুন নামের এক যুবকের কথাই ধরা যাক। প্রচণ্ড গণিতভীতি ছিল তাঁর। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়াও করতে চাইতেন কম। মামুনের মতে, পড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়ার মতো কোনো পরিবেশও ছিল না। পরীক্ষায় ভালো করতেন না বলে শিক্ষকরা তাঁকে অপছন্দ করতেন। আর ফেল করে এসে শুনতেন মা-বাবার বকা। একপর্যায়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন, লেখাপড়া আমার জন্য নয়। মামুন এখন ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করেন। লেখাপড়া করতে না পারলেও তিনি ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ কিভাবে দ্রুত শিখে ফেললেন? এমন প্রশ্ন করলে মামুন বলেন, ‘জিনিসটা মজার। করতে করতে শিখে ফেলেছি।’ তড়িৎকৗশলের ভারী বইয়ের জটিল ভাষা তিনি না বুঝলেও বিদ্যুতের পজিটিভ-নেগেটিভের ভাষা ঠিকই বোঝেন। কোথায় কোন চার্জ বা কত ভোল্টের বিদ্যুতের প্রয়োজন, সেসব বোঝেন। নির্ভুলভাবে পুরো একটি বাড়ির ওয়্যারিং করে দিতে পারেন। আর এ কারণে তার এখন মনে হয়, লেখাপড়াটা কষ্ট করে হলেও চালিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল।
মামুনের মতো পরিস্থিতিতে হয়তো তোমাদের অনেককেই পড়তে হয়েছে। এমন একটা সময় আসে, যখন মনে হবে, পড়াশোনা আমার জন্য নয়। কিন্তু দেখা গেল, মামুনের মতো ইলেকট্রনিকসে তোমার অনেক আগ্রহ বা বাগান করার প্রতি, কারো বা ফ্যাশনের প্রতি, আবার কারো শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে। আর এর প্রতিটিই কিন্তু পড়াশোনার বাইরের কিছু নয়। তাই একটু কৌশল খাটালেই মুক্ত হওয়া যায় মানসিক চাপ থেকে।
শাহিনুরের (ছদ্মনাম) প্রত্যাশা ছিল উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল হবে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। পরীক্ষার ক্ষণ ঘনিয়ে আসে। তাঁর মানসিক চাপও বাড়ে। প্রথম কয়েকটি পরীক্ষা ভালোই দিয়েছেন। কিন্তু পরের দিকে পড়ার চিন্তায় তার ঘুম গায়েব। আর তাই একদিন একটি পরীক্ষার সময় হলেই জ্ঞান হারান তিনি। জ্ঞান ফিরলে দেখেন, পরীক্ষার সময় অর্ধেক শেষ। তাই আর প্রত্যাশার কাছাকাছি যেতে পারেননি। তার প্রতি পরিবারের আশাও কমতে থাকে। ফলে মানসিক চাপটা তাঁকে আরো পেয়ে বসে। মানসিক চাপের কারণে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার গ্লানি এখনো তাড়া করে শাহিনুরকে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও এর কারণে ছাত্রদের মানসিক চাপের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বরেণ্য শিক্ষাবিধ অধ্যাপক যতীন সরকার। তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, পাঠ্যসূচি যেটি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিই হচ্ছে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই পাঠ্যসূচিকে আরো সহজ করে দেওয়া ভালো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ছেলেকে পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে এখানে-ওখানে দৌড়াতে হয়। তার পাঠ্যসূচিটা এমন যে এটাকে হজম করা তার পক্ষে অসম্ভব। আমরাও তো প্রাইমারি স্কুলে পড়ে এসেছি। আমাদের তো মনেই হয়নি, আমাদের ঘাড়ে কোনো বোঝা আছে, চাপ আছে।’
চাপের লক্ষণ
অনেকেই আছে, চাপ বোধ করলেও ঠিক বুঝতে পারে না তা কতখানি। শরীরে কিছু পরিবর্তন দেখলেই বুঝতে পারবে, নিজের ওপর বেশি চাপ দিয়ে ফেলছ তুমি। লক্ষণগুলো হলো, হাত-পা কাঁপা, সাধারণ অসুখেই বেশি কাহিল হয়ে পড়া, বুকে ব্যথা, মাথাব্যথা, রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়া, ওজন কমে যাওয়া। আচরণেও কিছু পরিবর্তন, মানসিক চাপ ফুটিয়ে তোলে। যার লক্ষণ হচ্ছে, ধৈর্য কমে যাওয়া, নখ কামড়ানো, বাড়ির কাজ সময়মতো শেষ করতে না পারা, কোনো কিছুতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়া, আগে যা ভালো লাগত তা আর ভালো লাগছে না, বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।
পড়তে বসলে মনোযোগ বসছে না? তারিখ মনে রাখতে পারছ না? কোনো কিছুর শেষ সময় ভুলে যাচ্ছ? নিজেকে দুর্বল লাগছে? কথাই বলতে ইচ্ছা করছে না? কারণে-অকারণে মিথ্যা বলছ? এমন কিছু যদি টের পাও, তবে যত দ্রুত সম্ভব বড়দের জানাও। সাহস করে শিক্ষকের সঙ্গেও শেয়ার করা উচিত।
মা-বাবাকে বললে তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন। কারণ তাঁরাও তোমার লেখাপড়ার চাপ নিয়ে সচেতন। গৃহশিক্ষক, কোচিং, ক্লাস—সব মিলিয়ে তোমার কষ্টটা তাঁরাও বোঝেন। তাই তুমি বিষয়টি বোঝাতে পারলে তারা হয়তো এমন কিছু করবেন, যাতে তোমার অবসাদ কেটে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত খেলাধুলা করতেও ভুলো না। কারণ তোমাদের অনেকের স্কুলে খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই। এটি নিয়ে তোমাদের শিক্ষকরাও বেশ চিন্তিত থাকেন। একজন শিক্ষক বলেন, শ্রেণি শিক্ষক, পরিবার, কোচিং আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ দেয়। এতে তাদের জীবনে বিনোদন থাকছে না। অনেক স্কুলে তো খেলাধুলাই হয় না। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা প্রয়োজন।
তাই বলে স্কুলের ওপর অভিমান করে থেকো না। সমস্যা যা-ই হোক, শিক্ষককে বিস্তারিত জানাও। পরামর্শ নাও।
মানসিক স্বাস্থ্য জরুরি
কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁদের সন্তানরা কখনো পড়াশোনার চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছে কি না? সবাই জানিয়েছেন, খুব বেশি অসুবিধা হয়নি, তবে মাঝেমধ্যে জ্বর, মাথাব্যথা হয়। এ সময় ডাক্তারের পরামর্শও নেন তাঁরা। তবে কেউ কখনো কোনো মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হননি বলে জানান।
এ প্রসঙ্গে মনোবিদ ডা. রামিয়া মোহনের মতে, অতিরিক্ত মানসিক চাপের বেশি প্রকাশিত লক্ষণ হচ্ছে ঘুম ভেঙে যাওয়া, খাওয়া কমে যাওয়া, মেজাজ ঠিক না থাকা, প্রচুর চিন্তা করা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, হতাশা, রাগ, ফেল করার ভয়ে আচ্ছন্ন থাকা। অল্প বয়সেই এগুলো একজন শিক্ষার্থীর বিষণ্নতা, খাওয়া ও ঘুমের বিশৃঙ্খলার মতো দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, সমস্যা বুঝতে পারা ও দ্রুত তার সমাধানের ব্যবস্থা করা এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে শিক্ষকের এবং এই দুই পক্ষের সঙ্গে শিক্ষার্থীর ভালো যোগাযোগ থাকতে হবে। শিক্ষার্থীর পরিশ্রমকে উৎসাহ দিতে হবে। দিনের শেষে সন্তানের সঙ্গে তার দিন কেমন কাটল, সেটা জিজ্ঞেস করা ও উৎসাহব্যঞ্জক কিছু কথা বললেও তা শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করে। আর মানসিক চাপের বেশি বেশি লক্ষণ দেখা গেলে অবশ্যই মানসিক ডাক্তারের কাছেও যাওয়া উচিত।
স্কুল-কলেজের মানসিক চাপ সম্পর্কে সাইকোলজি টুডেতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ থাকবে। তবে সেটি যেন মানসিক রোগে পরিণত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবার, বন্ধু ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এসব স্ট্রেসকে অনেক নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদিও এর আগে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে হেলথ প্রোগ্রামগুলো সচল নেই।
তোমাকে যা করতে হবে
১. মানসিক চাপ বোধ করা মাত্রই ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে চাপের কারণটা আগে বের করো। এরপর ঝটপট কারণগুলো টুকে নাও। যেমন : ক) গণিতের তিন চ্যাপ্টার বাকি। খ) কেমিস্ট্রির কয়েকটা বিক্রিয়া মনে পড়ছে না। গ) রোহান আমার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি নম্বর পেয়েছে। ঘ) নতুন অ্যানড্রয়েড ফোনটা পেলে ভালো হতো। এবার তালিকার পাশে টুকে নাও কিছু নাম, যার সঙ্গে তুমি বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারবে।
২. স্কুল চলার সময় শরীর বেশি খারাপ লাগলে শিক্ষককে বলে ছুটি নিয়ে নিতে পারো।
৩. মানসিক চাপে থাকলে যতই পড়া থাকুক, রাত জাগা চলবে না। তাতে যা জানতে তা-ও হয়তো ভুলে যাবে।
৪. কোনো বিষয় না বুঝলে ঘাবড়ে যাওয়া চলবে না। প্রয়োজনে ওই বিষয়ের শিক্ষকের ফোন নম্বরটি টুকে রাখো। বুঝতে সমস্যা হলে প্রয়োজনে সময় বুঝে ফোন কোরো।
৫. খাওয়ার বেলায় ছাড়াছাড়ি নেই। বেশি করে পানি আর ফল খাও। সঙ্গে সব সময় পানির বোতল রাখো। একটু পর পর চুমুক দিলেও তাতে কাজ হবে।