সাক্ষাৎকার : ট্রিপল ‘ই’ একটি ডায়নামিক সাবজেক্ট
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
প্রফেসর ড. মো. রিজওয়ান খান বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যাঞ্চেলর। দেশের পাওয়ার ও অ্যানার্জি সেক্টর নিয়ে হাতেগোনা যে ক’জন ব্যক্তি গবেষণা করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করেছেন। দেশে ইইই শিক্ষার বিস্তারে অনন্য ভূমিকা রাখা এ শিক্ষাবিদ ২০১৭-’১৮ সালের জন্য ইইই ইঞ্জিনিয়ারদের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পেশাদার সংগঠন- ইন্সটিটিউট অব ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিসটিংগুইসড লেকচারার হিসেবে মনোনিত হয়েছেন। ইইই গ্রাজুয়েটদের প্রসপেক্ট ও জব অপরচ্যুনিটিসহ চাকরি প্রার্থীদের প্রস্তুতির বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে নানা কথা বলেছেন ড. রিজওয়ান।
: ইইই গ্রাজুয়েটদের জব অপরচ্যুনিটি সম্পর্কে জানতে চাই?
ড. রিজওয়ান খান : ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) একটি ডায়নামিক সাবজেক্ট। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পছন্দ তালিকার শুরুর দিকেই অবস্থান করছে এটি। এর কারণও আছে। দেশে-বিদেশে এ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। দেশে পাওয়ার সেক্টর গ্রো করছে। সেখানে এ বিষয়ের গ্রাজুয়েটদের কাজের যথেষ্ট চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। দেশে ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ইলেকট্রনিক কোম্পানিগুলো ভালো বেতনে ইইই গ্রাজুয়েটদের নিয়োগ দিচ্ছে। নবায়নযোগ্য অ্যানার্জি সেক্টরসহ বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ের ডিগ্রিধারীদের চাকরি হচ্ছে। আইসি সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইইই ইঞ্জিনিয়ারদের প্রসপেক্ট ভালো। এছাড়া কমিউনিকেশন সেক্টর বিশেষ করে টেলিকম কোম্পানিগুলোতে এ বিষয়ের গ্রাজুয়েটদের চাহিদা রয়েছে। ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের আয়ের একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠছে আউটসোর্সিং। পাওয়ার সার্কিটসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে ঘরে বসেই ভালো আয় করতে পারবেন আউটসোর্সাররা।
: সরকারি কোন কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাচ্ছে ইইই গ্রাজুয়েটরা?
ড. রিজওয়ান খান : বিটিটিবি, বিটিআরসিসহ টেলিকম সেক্টরে সুযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শুরুতেই অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরিতে নিয়োগ পান তারা। আণবিক শক্তি কমিশন, জাতীয় বিদ্যুৎ বোর্ডসহ রাষ্ট্রায়ত্ব বিভিন্ন পাওয়ার জেনারেটর কোম্পানিতেও চাকরির সুযোগ হচ্ছে। বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। যারা ট্র্যাক চেঞ্জ করতে চান তারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রায়ত্ব ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকেও চাকরিতে যোগ দিতে পারেন। মেধাবীরা শিক্ষকতা-গবেষণাও করতে পারে। দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইইই বিষয়ের প্রচুর শিক্ষক দরকার হচ্ছে।
: টেলিকম কোম্পানিগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর কোন যোগ্যতা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়?
ড. রিজওয়ান খান : টেলিকমিউনিকেশন রিলেটেড বিষয়গুলোতে আবেদনকারীর কতটুকু দখল আছে সেটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়া হয়। এছাড়া আবেদনকারীর কমিউনিকেশন স্কিল, স্মার্টনেস, আর্ট অব প্রেজেনটেশন এসব বিষয় দেখা হয়।
: দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইইই পড়ানো হচ্ছে?
ড. রিজওয়ান খান : বুয়েট, রুয়েট, ডুয়েট, কুয়েট, চুয়েটসহ দেশের প্রতিটি পাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইইই পড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বিবেচনায় নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে।
: ইইই পড়ানোর জন্য যে ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ দরকার, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেটি আছে বলে আপনি মনে করেন কি?
ড. রিজওয়ান খান : ইইই ছাত্রদের ব্যবহারির শিক্ষা নিশ্চিত করতে যে ধরনের ল্যাব দরকার সেটি খুব একটা এক্সপেনসিভ না। কম খরচেই ল্যাব ডেভেলপ করা যায়। তবে কিছু কিছু সফটওয়্যার রয়েছে বেশ দামি। যেমন আইসি সফটওয়্যার কেডেন্স, দাম ২০ লাখের বেশি। এগুলো অপারেট করতে দক্ষ জনবল দরকার। আমার তো মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ শিক্ষার বিস্তারে আন্তরিক হলে ছাত্রদের ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়।
: ইইই শিক্ষাটা এখনও ততটা পরিচিত হয়ে উঠেনি। এটি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের জায়গা কতটুকু ধরতে পেরেছে। আপনার মূল্যায়ন…
ড. রিজওয়ান খান : ইইই ডিসিপ্লিন নতুন নয়। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। শুরুতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং নামে বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে। আর শিক্ষার্থীদের ঝোঁকের বিষয়ে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে- সামগ্রিকভাবেই বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। সেই তুলনায় বিজনেস স্টাডিসসহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে আমি বলব, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সায়েন্সের ছাত্রদের যে শিক্ষাটা দেয়া হচ্ছে সেটি যথাযথ নয়। বড় একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে গণিত ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ধরা পড়ছে। এর ফলে অনেকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভর্তি হয়েও পরে ড্রপ আউট করে। পাসের হার ও জিপিএ বাড়লেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত আমাদের শিক্ষার মান কতটা বাড়ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তাই এখনই যদি আমরা বিজ্ঞানের ছাত্রদের প্রতি বিশেষ যত্ন না নেই তবে বিজ্ঞান শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে পড়ব। এটি হবে আমাদের জন্য উদ্বেগের।
: ইইই ছাত্রদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হচ্ছে কতটা?
ড. রিজওয়ান খান : ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রচুর ছাত্র বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েটের বহু গ্রাজুয়েট প্রতিবছর বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের মধ্যেও কেউ কেউ সুযোগ পাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ড ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার খরচ কম। কিন্তু ভাষা শিখতে হবে। সেই সঙ্গে ভিসা জটিলতাও রয়েছে। সেই তুলনায় বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ পাওয়া সহজ। যারা সেখানে পড়তে যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই সেখানে চাকরি কিংবা গবেষণায় ঝুঁকে পড়ছে। কারণ ওইসব দেশে একদিকে যেমন চাকরি পাওয়া সহজ তেমনি বেতনও ভালো। এছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করার সুযোগ তো আছেই। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেয়া গ্রাজুয়েটদের দেশে পর্যাপ্ত চাকরির ব্যবস্থা করা গেলে দেশ লাভবান হতো।
: সম্প্রতি এইচএসসির ফল বেরিয়েছে। কোন বিষয়ে পড়বে, কোথায় চান্স হবে এসব নিয়ে শিক্ষার্থীরা চিন্তিত। তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
ড. রিজওয়ান খান : ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যেখানে পড়তে চায় সেখানে ভর্তির জন্য এখন থেকেই জোর প্রস্তুতি নিতে হবে। আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলে সফলতা ধরা দেবেই। এ সময় অনেকেই সাবজেক্ট চয়েজে ভুল করে। অভিভাবকদের আগ্রহে বিষয় পছন্দ করে, ভর্তির পরে অনেকে পড়ার বিষয়ে আগ্রহ খুঁজে পায় না। পছন্দের বিষয় নির্বাচন ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। বাজারে চাহিদা আছে, সরাসরি কাজের ক্ষেত্র আছে এমন বিষয় বেছে নেয়াই ভালো।
: চাকরি প্রার্থীদের প্রতি আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ…
ড. রিজওয়ান খান : বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরে শতকরা ৯০ জন চাকরি হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে হলে ইংরেজিতে ভালো দখল থাকতে হবে। কারণ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের প্রধান শর্ত হচ্ছে ইংলিশ ও কমিউনিকেশ স্কিল। চাকরি প্রার্থীদের এটা বাড়াতে হবে।