পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পরিকল্পিত শহর

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পরিকল্পিত শহর

  • তৌহিদুর রহমান

সিন্ধু নদের তীরে প্রায় ৪৬০০ বছর আগে মাটির নীচে চাপা পড়ে যাওয়া এক শহরের নাম মহেঞ্জোদারো। মহেঞ্জোদারো শব্দের অর্থ মৃতের উপত্যকা। প্রত্নতাত্ত্বিক দের মতে ৪৬০০ বছর আগেও মহেঞ্জোদারো শহরটি ছিলো বর্তমান সময়ের আধুনিক শহরগুলোর মতোই। বিজ্ঞান, শিল্প ও সভ্যতা আবিষ্কারের হাজার হাজার বছর বছর আগেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি শহরের মানুষের চলাফেরা কিভাবে এত উন্নত ছিলো তা অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগায়।

মহেঞ্জোদারো শহরটি বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত ছিলো। ১৮৫৬ সালে একজন বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সেই অঞ্চলে রেললাইন স্থাপনের কাজ করছিলেন। রেললাইনে বসানোর জন্য তিনি শক্ত পাথর খুজছিলেন। তখন তিনি মাটি খুড়ে একধরনের পাথর পান, যা দেখতে অনেকটা বর্তমান যুগের ইটের মত। তিনি আরও লক্ষ্য করেন সেই এলাকায় বসবাসকারীরাও একই রকম পাথর দিয়ে বাড়ি তৈরি করেছে। তিনি সেসকল বাসিন্দাদের কাছে জানতে পারেন তারা মাটি খুড়ে এসব পাথর সংগ্রহ করেছে। তখন তিনি বুঝতে পারেন কোন মূল্যবান প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে সেই অঞ্চলের মাটির নীচে। 

এরপর ১৯২২ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ববিদ রাখালদাস ব্যানার্জি এই অঞ্চলে খনন কাজ চালান। সেখানে তিনি একটি বৌদ্ধমূর্তির মাথা খুজে পান এবং বুঝতে পারেন সেই অঞ্চলে একটি প্রাচীন শহরের অস্তিত্ব রয়েছে। তারপর ১৯২৪ সালে আরেক ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কাশীনাথ নারায়ণ সেখানে খননকার্য শুরু করেন এবং ১৯২৫ সালে জন মার্সেল নামে এক বৃটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকও সেখানে খনন কাজ শুরু করেন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সেখানে খনন কাজ চালিয়ে হারানো মহেঞ্জোদারো শহরের প্রায় এক  তৃতীয়াংশের মত  জায়গা মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় বলে সেখানে খননকার্য বন্ধ করে দেয়া হয়।

তবে, এর মাঝে খনন করে বড় বড় পাকা বাড়ি, বাধানো জলাশয়, বিভিন্ন চিত্রকলা, ধাতু এবং মাটির তৈরি বাসনপত্র, প্রাচীন মূর্তি, অলংকার সহ আরও অনেক কিছুই উদ্ধার করা হয়। যেগুলো থেকে সেই সময়ের মহেঞ্জোদারোর মানুষের উন্নত জীবন যাপনের ধারনা পাওয়া যায়। পাচ হাজার বছর আগে যে সময় ইউরোপ আমেরিকার মানুষ গুহা আর জঙ্গলে বাস করতো তখন মহেঞ্জোদারোর মানুষেরা পাকা বাড়িতে বসবাস করতো। যা সত্যিই অনেক বিষ্ময়কর। উৎসাহের কারনে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ই সেখানে অনেকবার খননকার্য চালিয়েছে তবে আজ পর্যন্ত মহেঞ্জোদারোর এক তৃতীয়াংশই খনন করা সম্ভব হয়েছে।

ধারনা করা হয়, শহরটি ২০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে অবস্থিত ছিলো এবং সেখানে ৫০ লক্ষ মানুষ বসবাস করতো। শহরটির চারদিক সুরক্ষার জন্য শক্ত ইটের পাচিলে ঘেরা ছিলো। শহরে ঢোকার জন্য শহরটির মুখে একটি বড় সদরদরজা ছিলো।

মহেঞ্জোদারোকে সিন্ধু সভ্যতার অংশ বলা হয়ে থাকে। তবে সেখানে বেশিরভাগই প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার লোকজন বসবাস করতো। মহেঞ্জোদারোর উদ্ধারকৃত উন্নত বাড়িঘরগুলো দেখে মনে হয় এগুলো বড় বড় প্রকৌশলীদের তৈরি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক দের মতে সেগুলো আরবান কারিগরদের হাতে তৈরি।

মহেঞ্জোদারোর ইটের তৈরি ঘরগুলোতে পাওয়া যায় পাথরের তৈরি শৌচাগার এবং স্নানঘর। সেগুলোর নির্মাণশৈলি ও নিখুঁত কারুকার্য যে কাউকে তাক লাগিয়ে দেয়। শহরের মাঝখানে রয়েছে গ্রেট বাথ নামে বিশাল স্নানাগার যেখানে শহরের মানুষ পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য স্নান করতো বলে ধারনা করা হয়।

নোংরা পানি নিষ্কাশনের জন্য শহরের ভেতর নর্দমা ও নালাও। বর্জ্য পানি যাতে শহরের নর্দমায় গিয়ে পড়ে সেরকম বন্দোবস্তও রাখা ছিল। সেগুলো ছিলো মানুষের হাতে তৈরি প্রথম নালা বা নর্দমা। এ থেকে বুঝা যায় সেখানকার বাসিন্দারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিলো।

এছাড়া পৃথিবীর প্রথম পাতালকূয়া গুলো মহেঞ্জোদারোর মানুষেরাই বানিয়েছিলো। সেখানে খননকার্য চালিয়ে ছোট বড় ৭০০ এর মত পাতালকূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া শহরের ভিতরে চলাচলের জন্য বেশ সাজানো গোছানো রাস্তাও ছিলো। মহেঞ্জোদারোর মানুষের আরও কিছু বিষ্ময়কর স্থাপত্য রয়েছে। 

তখনকার সময়ে তাদের বানানো সব ইটের ওজন ও পরিমাপ একই ছিলো। যা থেকে পুরাতত্ত্ববিদ রা ধারনা করেন সেই শহরের মানুষেরা গণিতের উপর জ্ঞান অর্জন করেছিলো। তারা যোগ বিয়োগ জানতো। যদিও পাঁচ হাজার বছর আগে গনিতের ব্যবহার এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ একদমই অকল্পনীয় ব্যাপার।  

মহেঞ্জোদারোর মানুষেরা গানবাজনা ও খেলাধুলা করতো। মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা ধাতুর তৈরী বাদ্যযন্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের মাটির ও ধাতুর তৈরী খেলনা দেখে এমন ধারনা করেন অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক। এছাড়া মাটির নিচ থেকে ধাতুর তৈরী নকল দাঁতও উদ্ধার করা হয়। যা থেকে ধারনা করা হয় মহেঞ্জোদারো শহরে চিকিৎসা ও ডাক্তারও ছিলো। আবার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক এর মতে, এত হাজার বছর আগে চিকিৎসার আবিষ্কার কোনভাবেই সম্ভব নয়। 

এছাড়াও খনন করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য, নিখুঁত কারুকার্য করা অলংকার, মূর্তি ও বাসনপত্র উদ্ধার করে বিভিন্ন সংগ্রহশালায় রাখা হয়। যেগুলো তখনকার সময়কার আধুনিকতার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। 

অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারনা ১৯০০ খ্রীস্টপূর্বে হঠাৎ করে যখন সিন্ধু সভ্যতার পতন হয় তখন এই শহরেরও পতন হয়। তবে মহেঞ্জোদারোর পতন নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বিশাল ভূমিকম্পের ফলে মাটির নীচে তলিয়ে যায় শহরটি। কেউ কেউ বলেন, ভয়াবহ বন্যাই শহরটির পতনের কারন।

আবার, সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের কারনেই শহরটি তলিয়ে যায় বলে ধারনা করা হয়। তবে ঠিক কিভাবে এই শহরের সৃষ্টি হয়েছে এবং কি কারনে এর ধ্বংস বা পতন হয়েছে তা আজও সঠিক জানা যায় নি। এত হাজার বছর আগেও মহেঞ্জোদারো কিভাবে এত উন্নত শহরে পরিনত হয়েছিলো সেই রহস্য জানতেও খোঁজ এবং গবেষণা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

Sharing is caring!

Leave a Comment