বাংলার কৃষিপণ্য ১৪০ দেশে

বাংলার কৃষিপণ্য ১৪০ দেশে

  • অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক

চা, কাঁচা পাট, হিমায়িত খাদ্য ও কৃষি পণ্যের রফতানি আয় বছরে ৮ হাজার কোটি টাকা। উন্নত প্রযুক্তিতে চাষ হওয়া কাঁকড়া রফতানি ২০ দেশে।

দেশের বাইরে দিন দিন বাড়ছে কৃষিপণ্যের চাহিদা। আর এই চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ। কৃষি পণ্য উত্পাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পর তা রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে। ১০০’র বেশি প্রতিষ্ঠান সরাসরি খাদ্যপণ্য উত্পাদন ও রফতানি দুটিই করছে। আর ১৪০টি দেশে এ সব কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য আমদানি করছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোতেই ১৫০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানির সুযোগ আছে বলে মনে করেন তারা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে চা, কাঁচাপাট, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি পণ্যের রপ্তানি আয় ৮ হাজার কোটি টাকা।

সয়াবিন ও ডালসহ বেশিরভাগ খাদ্যশস্যই আমদানি করে বাংলাদেশ। সেখানে বিভিন্ন কৃষিপণ্য উত্পাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে আশার আলো দেখাচ্ছেন কৃষকরা। খাদ্যশস্য উত্পাদনে সরকার সার ও বীজসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি প্রদানের পাশাপাশি গত অর্থ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। এ ছাড়া ৩৭টি কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতে ৪৫০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন সুবিধা প্রদান করছে। কৃষি উত্পাদন বাড়াতে সরকারের রয়েছে নানামুখী কর্মসূচিও। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, গবেষণা বৃদ্ধির মাধ্যমে অল্প জমিতে বেশি শস্য উত্পাদন করতে হবে। তবেই নিজেদের চাহিদা পূরণ শেষে অন্যের চাহিদাও পূরণ করা যাবে।

কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ৯০ ধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকৃত খাদ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে ফলের জুস, পানীয়, স্ন্যাকস, বিস্কুট, ক্যান্ডি, আলু, মুড়ি, চিড়া, মসলা, সিঙ্গাড়া, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, বাবল গাম, চানাচুর, ডাল ভাজা ও চিপস, কনফেকশনারি পণ্য, জ্যাম ও জেলি, বিভিন্ন ধরনের সস, কাসুন্দি, আলুপুরি, সবজির রোল, লুচি, সমুচা, জর্দা, হিমায়িত মাশরুম, বাদাম ভাজা, বিভিন্ন ধরনের চাটনি ও আচার, নুডলস, বিভিন্ন ধরনের সেমাই, লুচি ও পরোটা, খেজুর রস, মধু, পাপড়, বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত সবজি। বেশি রপ্তানি হয় জুস, পানীয়, বিভিন্ন ধরনের মসলা, মুড়ি, চাটনি, আচার, হিমায়িত সবজি ও সেমাই।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, মরিশাস, ভারত, সুইডেন, গ্রিস, ক্যামেরুন, সাইপ্রাস, জাপান, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স, ব্রুনাই, কুয়েত, ভুটান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইথিওপিয়া, বাহরাইন, গাম্বিয়া, গিনি, আইভরি কোস্ট, ইতালি, সিয়েরা লিয়ন, শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, সেনেগাল, নাইজার, নেপাল, পাকিস্তান, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এ সব কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। তবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যের প্রধান প্রতিযোগী ভারত। এ ছাড়া আছে ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ব্রাজিল।

বাড়ছে রপ্তানি

প্রতিবছরই উল্লেযোগ্য হারে বাড়ছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যের চাহিদা। বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ অর্থ বছরে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১৭২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার পণ্য। এরপর ২০১০-১১ অর্থ বছরে রপ্তানি করে আয় হয় ৪৪৮ কোটি টাকা। যা ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এসে দাঁড়িয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটিতে।

২০১৫ সালে রপ্তানিতে ভর্তুকি পাওয়া কৃষিজাত পণ্য ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কৃষিজাত পণ্যের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে টিনজাত আনারস, টিনজাত বেবিকর্ন ও টিনজাত ঘৃতকুমারী।

বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আহমেদ ফরহাদ বলেন, দ্রুত প্রসার ঘটছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যের বাজারের। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এ খাতের। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে তা দূর করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ

সবজি মধ্যপাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে বেশি। দেশের সব এলাকাতেই এখন সবজি চাষ হয়। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, লন্ডন, কানাডা, দুবাই, ইতালীসহ মধ্যপাচ্য ও ইউরোপের প্রায় ৫০টি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে রজবপাতা, লাউপাতা, লাউ শাক, বরবটি, কাকরোল, উসতে, ঝিঙে, লালশাক, ডাটা, জালি, কচুমুখী, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, টমেটো, পটল, চাল কুমড়া, লাউ, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা কলা, শসা ও শীতকালীন সবজি শিম, লাউ, বাঁধা কপি, ধনিয়া পাতা, টমেটো, কাঁচা মরিচ, মুলাসহ অর্ধশতাধিক সবজি।

৯০ দেশে যাচ্ছে পাটজাত পণ্য

বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। পাটজাত পণ্য ভারত, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকা, সিরিয়া, সুদান, ইরান, ইরাক, রাশিয়া, আমেরিকা ও কানাডাসহ ৯০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বিজেএমসির কারখানাগুলোতে উত্পাদিত পাটজাত পণ্যের পরিমাণ ৯৫ হাজার টন।

চাষ হচ্ছে কাঁকড়া

উন্নত প্রযুক্তিতে চাষ হচ্ছে কাঁকড়া। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাষ করা কাঁকড়া এখন রপ্তানি হচ্ছে অন্তত বিশটি দেশে। নতুন এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারের কাঁকড়ার সুখ্যাতি।

আলু: রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আলু রপ্তানি হয় বেশি। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৬ হাজার টন আলু রপ্তানি করে আয় করে ৩ কোটি ২২ লাখ ডলারেরও বেশি। তবে ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়া দেশটিতে আলু রপ্তানি স্থগিত রয়েছে।

ওয়ালমার্টে গেছে আম

বিশ্বের আম রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর বিশ্বখ্যাত খুচরা পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট আম কিনেছে বাংলাদেশ থেকে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজার মিলিয়ে গত বছর ৮২১ টন আম রপ্তানি হয়েছে।

চা

বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল চা। চলতি মৌসুমে উত্পাদনে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৫ সালে ৬৭ মিলিয়ন কেজি চা উত্পাদন এ যাবত্কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে আগের মতোই চা রপ্তানি সম্ভব। গত এক দশক আগেও নানা জটিলতায় চায়ের উত্পাদন হ্রাস পেতে থাকে।

মধু

সারা বিশ্বে চাহিদা বাড়তে থাকায় মধু এখন রপ্তানি বাণিজ্যে সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মধুর ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নামকরা ব্র্যান্ড আর সফল উদ্যোগ। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধু রপ্তানি হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫০ টন অর্থাত্ ৫৫ কোটি টাকার মধু ভারত, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে।

হিমায়িত খাদ্য

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, মাছ উত্পাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। মুক্ত জলাশয় আর ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে চাষের মাছ দেশের মধ্যে যেমন বয়ে এনেছে মাছের বিপ্লব। ঠিক তেমনি রপ্তানি করে নিয়ে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

সম্ভাবনাময় খাত

সম্ভাবনাময় চার পণ্য হলো ছাগল ও ভেড়ার চামড়া, পশুর পশম, শিমজাতীয় শুকনো সবজি বা তার বিচি এবং কিছু ফল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানির ক্ষেত্রে এ চারটি পণ্যে (এইচএস কোডভিত্তিক) বাংলাদেশের বিশেষ কোনো প্রতিযোগীই নেই। এ কারণে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি এখনকার চেয়ে ১৫০ কোটি ডলার বাড়ানো সম্ভব। অন্যদিকে মাছ, মাংস, পশুর শিং ও বিভিন্ন অঙ্গ, আলু ও বিভিন্ন সবজি, চা, রুটি, বিস্কুট, কেক, জুস, মিনারেল ওয়াটার, তামাকসহ ৫৪টি পণ্যে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ভালো করবে এমনটি জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে প্রায় ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

সরকারি উদ্যোগ

দেশের রফতানি বাণিজ্যিকে উৎসাহিত করতে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি কৃষি পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ও ভর্তুকির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের গত ১ জুলাই থেকে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত জাহাজে করে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেওয়া হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বলেন, কৃষিপণ্য রপ্তানি এখন সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের অনেকে মানুষ এখন দেশের বাইরে রয়েছে। তাদের বাংলাদেশি কৃষিপণ্যে চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া অন্যদেরও চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা পূরণের মাধ্যমে আমরা রপ্তানি আয় বাড়াতে পারছি।

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment