আমার প্রথম হুমায়ূন আহমেদ দর্শন
মোস্তাফিজুর রহমান : তখন আমার বয়স ১৩ কি ১৪। দাদাভাই বেচে। এক শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে দাদা ভাইয়ের সাথে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছি। তখন কাছাকাছি মসজিদ ছিল দক্ষিন পাড়ায়, আমাদের বাড়ি থেকে পায়ে হেটে প্রায় ১০ মিনিটের পথ। শীতের দিনগুলোতে রাস্তাটা ঠনঠনে শুকনো থাকে। কিন্তু গোল বাধে বর্ষাকালে – পিচ্ছিল আর পিচুটি কাদায় একাকার হয়ে যায়। আমরা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে যেতাম – আসলে পায়ে পরে না, হাতে নিয়ে – আর মসজিদের চাপকল থেকে পা ধুয়ে মসজিদে উঠতাম। চাপকলে পা ধুতে ধুতে দেখতাম অন্যান্য মুছল্লি – যাদের বেশিরভাগই সম্পর্কে আমর দাদা, চাচা – তাদের পা কাদায় খেয়ে সাদা ঘাঁ করে ফেলেছে। আমার পা-এ ওসব হতো না। তবুও পা ধোয়ার সময় বারবার আঙুলের ফাকে দেখতাম কাদায় খেয়েছে কিনা!
যখনকার কথা বলতে চলেছি, ভাগ্যিস তখন বর্ষাকাল ছিল না, ছিল শীতকাল। কাজেই রাস্তা ঠনঠনে। জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে মাত্র বের হয়েছি। মসজিদের পাশের এক বাড়ির সামনে লাল ফ্রগ পরা ঘাড় সমান কার্লি চুলের এক সুন্দরীকে দেখলাম। সত্যি বলছি, প্রথম দর্শনেই কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়েছিল; সম্ভবত প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু, তখন অব্দি বুঝতাম না এমন অনুভূতিকে প্রেম বলে! চেহারাটা চোখে লেগে রইল। মৃদু হাসিতে হেটে চলার সময় তার ছোট ছোট কার্লি চুলের নড়াচড়া, জামার কিনারার দোল, মাইকেল জ্যাকসনের মুন ওয়াকের মত অথচ ধীরে পা ফেলা, আমাকে শ্রেফ এলোমেলো করে দিয়েছিল। আমাকে খুব দ্রুতই হেটে যেতে হল। কেননা দাদাভাই এগিয়ে চলেছেন, তার সাথে তাল মেলাতে হবে। এরপর আমি রাস্তার পাশের গাছগুলোর পাতা দেখলাম, সব কার্লি করা।
দুপুরে খাবার জলের গ্লাসে মেয়েটার চুলের নড়াচড়া দেখলাম। আক্রান্ত কুকুরে কামড়ালে দীর্ঘদিন পর জলাতঙ্ক রোগ হয়, আর সুন্দরী মেয়েটাকে দেখার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমার প্রেমাতঙ্ক হয়েছিল। প্লেটের সাদা সাদা ভাত দেখছিলাম যেন মেয়েটার মুক্তসম দাত।
ঐ দিন বিকালে হাটতে বেরিয়ে কেন জানি ঐ পথটাই পছন্দ হল আমার। ঠিক ঐ বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম কিছুই পরিবর্তন হয়নি, সবকিছু আগের মতই আছে। সে বুঝি জানত আমি আসব, তাই আগের মতই ধীর পায়ে পায়চারী করছে। আবারও লাল ফ্রগ, কার্লি চুল আর হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটাকে দেখে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হল।
তবে আগের মত এবার শুন্য হাতে নয়। আমি চিনি না, জানি না ভঙ্গিতে ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছি। আমার সম্পুর্ণ মনোযোগ আর দৃষ্টি তার লাল জামা, দুলতে থাকা চুল, চোখ আর হাতে থাকা বইয়ের উপর। আমাকে দেখে সে হাতের বইটা বন্ধ করলো। ডান হাতের তর্জনী বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে এক হাতে বইটা নিয়ে আমার দিকে তাকালো। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল; অনেকক্ষণ। কতক্ষন তা মনে নেই। তবে সেই দৃষ্টিতে আমি নতুন এক পৃথিবী দেখেছিলাম। সেই প্রথম, সেই শেষ! আর কখনো দেখা পায়নি তার।
দুপুরে খাবার জলের গ্লাসে মেয়েটার চুলের নড়াচড়া দেখলাম। আক্রান্ত কুকুরে কামড়ালে দীর্ঘদিন পর জলাতঙ্ক রোগ হয়, আর সুন্দরী মেয়েটাকে দেখার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমার প্রেমাতঙ্ক হয়েছিল।
পরদিন কি এক কাজের ছুতোয় আবার ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম; আসল উদ্যেশ্য ছিল অন্য। ছোট্ট এক পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের বাড়িতে লাল জামা পরা কোন মেয়ে আত্মীয় এসেছে? ছেলেটা বলছিল, ‘এসেছিল। আজ সকালে চলেও গেছে।’ আমি জীবনে দ্বিতীয়বার আর কখনো কার দেখা পায়নি! হয়তো আর কখনো পাবোও না। কিন্তু আমি জানি, আমার বসয় ৯০ পূর্ণ হওয়ার দিনও নাম না জানা ঐ রমনী তার কার্লি চুলে লাল জামা পরে তরুনী পায়ে আমার হৃদয় আঙিনায় পায়চারী করবে। তার কার্লি চুল হাজার বছর ধরে দুলতে থাকবে, যতদিন আমার আত্মা বাচে!
আমি তাকে হারিয়েছি সত্যি। কিন্তু বই হাতে সেই বিকালে দ্বিতীয়বার যখন তাকে দেখেছিলাম, তার চুল, চোখ, লাল ফ্রগের সাথে হাতের বইটাও পর্যবেক্ষন করতে ভুল করিনি। অনুজ্জল কালিতে লেখা বইটার নাম ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও চমৎকার প্রচ্ছদের উপর সাদা কালিতে লেখকের নামটা ঠিকই দেখেছিলাম; হুমায়ূন আহমেদ। সেই চিনলাম।
মেয়ে, আমি তোমাকে হারিয়েছি সত্যি, কিন্তু তোমার হাতে থাকা হুমায়ূন আহমেদকে হারায়নি। আজও আকড়ে আছি, থাকবো যতদিন বাচি। এখনও হুমায়ূন আহমেদের কোন নতুন বই খুলে দু-হাতে ধরলে মনে হয় যেন কার্লি চুলের নিচ দিয়ে তোমার মুখটাই সামনে ধরে আছি, পড়ছি তোমার চোখে লেখা না বলা কথাগুলো।