তারুণ্যের নৈরাশ্য অথবা কানা গলির পথিকেরা

তারুণ্যের নৈরাশ্য অথবা কানা গলির পথিকেরা

তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ে কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয় না।
_______________________________________রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মোস্তাফিজুর রহমান : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে ১২৩ বছর পূর্বে “ছুটি” গল্পে কথাগুলো বলেছিলেন বয়ঃসন্ধি কাল পার করা ছেলে মেয়েদের অবস্থা বোঝাতে। তার বহুবছর পর আজও কথাগুলো সমানভাবে প্রসাঙ্গিক, কখনো কখনো একটু বেশিই।

২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে নিজ বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করার অপরাধে সম্প্রতি তরুণী ঐশীকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে বিজ্ঞ আদালত। রায় শোনার পর থেকে একটা প্রশ্ন বারবার মাথার মধ্যে ঘুমপাক খাচ্ছে, সাজাটা কী ঠিক হল? আমরা এই রায়ের মাধ্যমে কী করলাম ? সতেরো আঠারো বছরের একটা বিপথগামী তরুণকে সংশোধন করলাম নাকি একটা ভূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে ফাসিতে ঝোলানোর হুতুম দিলাম ? প্রশ্নটা আলোচনার দাবী রাখে।

এই নিবন্ধটি ২০১৩ সালে ঐশীর বাবা মা হত্যাকান্ডের ঠিক কয়েকদিন পর লেখা। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে লেখাটি আবারও প্রকাশের দারি রাখে। সে কারনেই আবার কম্পিউটার থেকে লেখাটা খুজে বের করলাম এবং প্রকাশের প্রায়াস পেলাম।

আমি ঐশী নয়, বরং অন্য জায়গা থেকে শুরু করতে চাই। বয়ঃসন্ধি ব্যাপারটা আসলে ওপেন সিক্রেট! সমস্যাগুলো এমনই যে কাউকে বলাও যায় না, আবার পিড়াও দেয় সর্বোচ্চ! খুব সামান্য কারনে লংকা কান্ড বাধিয়ে দিতে ইচ্ছে করে! কিছু অপ্রয়োজনীয়, অপরিপক্ক চাওয়া এসে ভিড় করে মনে। খুব সহজেই অন্যের আচরণ প্রভাবিত করে। ক্ষণেক্ষণেই বিপরীত লিংঙ্গের মানুষের স্পর্শ পেতে মন চায়। বেছে বেছে নিষিদ্ধ জিনিসগুলো খুলে দেখতে ইচ্ছা করে।

পরাধীনতা আর স্বাধীনতার মাঝামাঝি এই সময়টা জীবনের যুদ্ধকাল! এই সময়টা ঠিকঠাক পার করে বিজয় অর্জন অর্থাৎ টিকে থাকতে প্রচুর মানসিক রসদ প্রয়োজন হয়। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন কি পারিপার্শিক সবাইকে এই বয়সি ছেলে মেয়েদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরী।

আমাদের সময় নবম শ্রেনীর পাঠ্য তালিকায় রবীন্দ্রনাথের “ছুটি” গল্পটি ছিল। কি এক অলৌকিক কারনে বর্তমানে তা পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তার বদলে বর্তমানে যে গল্প দেওয়া হয়েছে, তা আমার পড়া নেই বলে মন্তব্য করতে পারলাম না। যা হোক, আমরা সেই স্কুল জীবন থেকেই জানি বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যার কথা। এই বয়সে দূর্দমনীয়, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা, নিজেকে সবজান্তা জ্ঞান করা, নিজের ভুল অথবা আপ্রয়োজনীয় চাওয়াগুলোকে পাওয়ায় পরিণত করতে মরিয়া হয়ে ওঠা, এসব বয়সেরই বৈশিষ্ট।

চেনা বন্ধুদের হাত ধরে ঢুকে পড়ে অচেনা গলিতে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন আর বোকা সাধু সমাজে না পাওয়া বন্ধুটিকে খোজ করে ভিন্ন জগতে। পরিবার আর স্বজনদের কাছে না পাওয়া ভালোবাসা খুজতে এসে, পর্ণগ্রাফি আর নেশার নিষিদ্ধ জগতের একজন হয়ে উঠে। নেশা, যৌনতা আর উগ্রতা তাকে এমন রঙিন জগতে নিয়ে যায়, তাদের ভাষায় যা ঐ না পাওয়া ভালোবাসার পরিপূরক!

এই বয়সটা এমন যে সন্তানের খুব ছোট্ট চাওয়া পুরণ না করলে হয়তো লঙ্কা কান্ড বেধে যায়। একটু গল্পের ঢঙে বলার চেষ্টা করি: সন্তান হয়তো মায়ের কাছে এক গ্লাস পানি খেতে চাইছে! কিন্তু মা সাময়িক ব্যস্ততার কারণে সন্তানের হাতে পানি তুলে দিতে না পেরে বলে: আমি ব্যস্ত, তুমি ঢেলে খাও।

‘কি? আমি নিজে ঢেলে খাব? মা আমাকে পানি ঢেলে দিল না! সত্যিই তো মা আমাকে মোটেও ভালোবাসে না!’

তারপর এই চিন্তায় ডাল পালা গজাতে থাকে! গত পরশু একবার মা আমাকে বকেছিল। দিন সাতেক আগে মাকে একটা ছেলের কথা বলতে চেয়েছিলাম, শুরু করতেই আমাকে ধমক দিয়েছে! কয়েক মাস আগে স্কুল থেকে দেরি করে ফিরেছিলাম বলে, কেন দেরি করে ফিরলাম তার কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল! মা সত্যিই আমাকে বিশ্বাস করে না, ভালোবাসে না!

ঠিক এই সময় মস্তিকের নিউরনগুলো পজেটিভ কিছু ভাবতে পারে না। ব্যাস! এক গ্লাস পানি না দেওয়াতে মা হয়ে গেল সব চেয়ে বড় শত্রু! এসব নিশ্চিত ভাবেই অপরিপক্ক মস্তিকের ক্রিয়াকলাপ!

এই বয়সে যে তারা মোটেও পজেটিভ ভাবে না, তা নয়। পজেটিভ ভাবে, কিন্তু তার চেয় বেশি কাজ করে কৌতুহল! সে যা করতে যাচ্ছে, তাতে কি ঘটবে; তা সে জানে! কাজটা ভাল না মন্দ তাও জানে! তবুও পচা কাদায় পা দেয়, ঢুকে পড়ে কানা গলিতে! শিশুরা যেমন হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আঙ্গুলের ফাক দিয়ে ভুতের সিনেমা দেখে, তেমন! সে জানে সে ভয় পাবে, তবুও দেখে এবং নিশ্চিত ভাবেই ভয় পায়।

বয়ঃসন্ধিক্ষণের এমন সময়টাতে সন্তানের প্রতি বিশেষ নজর রাখার বিকল্প নেই। এই বয়সি কিশোর কিশোরীরা অনেকটা ‘খেপা কুকুর’-এর মত! একটু এলোমেলো হলেই কামড় দিবে; সেটা নিজের গায়ে হোক অথবা অন্যের গায়ে! বিপুল অর্থ খরচ করা, বাজে বন্ধুদের সাথে মেশা, নেশা করা, অশ্লীল ভিডিও দেখা, প্রেম করা, এর কোনটাই শুভ লক্ষণ নয়। কিন্তু এগুলোর প্রতিই তার আকর্ষণ থাকে বেশি! এ সময় মানসিক উৎকর্ষের সহায়ক, এমন ব্যবহার করে তার ভেতরের সুপ্ত থাকা ভাল মানুষটাকে জাগিয়ে তোলা, সুন্দর আর সত্যের পূজারী করে গড়ে তোলা, পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনের সবচেয়ে গুরু দায়িত্ব।

যত্ন, ভালোবাসার সামান্য কমতি হলেই সে বিকল্প খুজতে শুরু করে। আর তখনি চেনা বন্ধুদের হাত ধরে ঢুকে পড়ে অচেনা গলিতে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন আর বোকা সাধু সমাজে না পাওয়া বন্ধুটিকে খোজ করে ভিন্ন জগতে। পরিবার আর স্বজনদের কাছে না পাওয়া ভালোবাসা খুজতে এসে, পর্ণগ্রাফি আর নেশার নিষিদ্ধ জগতের একজন হয়ে উঠে। নেশা, যৌনতা আর উগ্রতা তাকে এমন রঙিন জগতে নিয়ে যায়, তাদের ভাষায় যা ঐ না পাওয়া ভালোবাসার (বড়দের ভাষায় যেটা বখে যাওয়া) পরিপূরক!

জন্মের পরেই একটা শিশু বখে যায় না! ধীরে ধীরে সে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং পারিপার্শিক সব কিছুকে চিনতে চিনতে বড় হয়। প্রতিদিন মিথ্যা, অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বার্থপরতা আর বিলাসিতা অথবা অভুক্ততার মধ্যে সে বেড়ে ওঠে। সে এসবকেই জীবনের চরম সত্য বলে মেনে নেয়! যদিও দূর্নীতিবাজ স্বজন বা আত্মিয়ের মত সেও জানে এসব অন্যায়।

আমাদের আরও একটা সমস্যা আছে – নিজ দেশের অবস্থান, পারিপার্শিকতা, সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে সন্তান পালনে রাজকীয় স্বপ্ন। আমাদের অনেক বাবা-মা বাংলাদেশে জন্মে, এ দেশে বসবাস করে স্বপ্ন দেখে সন্তানকে ইউরোপীয়ান করে গড়ে তুলতে! এটা নিশ্চত ভাবেই বিলাসিতা ছাড়া কিছ্ না! আপনি হয়তো বলবেন অর্থের কথা। এখানে অর্থটা মুখ্য বিষয় নয়! বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার থাকলেই বাংলাদেশের শহরে আলাদা করে মিনি লন্ডন বা মিনি নিউইয়র্ক সৃষ্টি করা যায় না!

একটা বাংলাদেশী ছেলে বা মেয়ে শিক্ষা-দিক্ষায়, মনে-প্রাণে ইউরোপীয়ান, অথচ সে বাস করে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বে! তাহলে তো বিপত্তি ঘটবেই! তার চিন্তা ভাবনা, মানসিকতা ইউরোপীয়ানদের মত, কাজেই দৈনন্দিন কাজকর্ম ইউরোপীয়ানদের মত করবে, এটাই স্বাভাবিক! তাহলে সে তো মদ খাবেই; ডিজে পার্টিতে যাবেই; অনেকগুলো বয়ফ্রেন্ড থাকবেই! তাকে নিষেধ করছেন কেন?

নিষেধ যদি করতেই হয়, তাহলে ওভাবে নয়। তার ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলুন। সে আধুনিক শিক্ষা নিবে, ইংরেজি মাধ্যমেই নিবে। কিন্তু মনে প্রাণে যেন হয় বাঙালী। আর নিজ ধর্মের সাম্যক জ্ঞান যেন শিশুকাল থেকেই আয়ত্ব করে এটা নিশ্চিত করা পিতা-মাতার কর্তব্য।

আজকাল স্কুল, কলেজ পড়ুয়া কিশোর কিশোরীদের আড্ডার একটা বড় অংশ বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড প্রসঙ্গ। যার বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড যত বেশি, দলে তার গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি! যার এসব নেই, সে এখনো বড় হয়নি অথবা সময় উপযোগী নয়! একাধিক বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড থাকা যে ভাল নয়, তা তারা সবাই জানে, তবুও এটাই আধুনিকতা! এটাই ফ্যাশান!

তারা যে এখান থেকে ফেরে না, তা নয়। ফেরে। কয়েক বছরের মধ্যেই ফেরে! কিন্তু যখন ফেরে, ততদিনে সর্বনাস যা হবার তা হযে গেছে। অপরপক্ষে সে তো বাঙালী; কোন না কোন ধর্মীয় পরিমন্ডলে বড় হয়েছে! তাই এই দৈত আচরণের জন্য সে নিজে নিজে অনুতপ্ত হয়, ব্যাপারগুলো ভুলে থাকতে নেশার আশ্রয় নেয়। সত্য সুন্দর জীবন আর সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতি তার কাছে অধরাই রয়ে যায়! favicon

Sharing is caring!

Leave a Comment