রোল কল থেকে পরীক্ষার ফল নৈরাজ্য রুখবে কে?
- ড. মো. কামরুল হাসান
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে রোল কল বা উপস্থিতি নিতে খুবই নিরুৎসাহী, কারণ এটা পাঠশালা বা স্কুল নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে যদি ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার নির্ণয় করতে হয়, তাহলে সেটাকে আর বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন এ নিয়ম ছিল না। জানি না কখন থেকে, কীভাবে এবং কাদের উদ্যোগে এ নিয়ম চালু হয়েছে। শুধু কি রোল কল করা হয়? ক্লাসে উপস্থিতির হারের ওপর নম্বরও আছে। আমি একদম প্রায় নিশ্চিত যে, বিশ্বে এমন দ্বিতীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে না, যেখানে ক্লাসের উপস্থিতির ওপর নম্বর দেয়া হয়। এটাও একটি লিটমাস টেস্ট আমরা যতটুকু না সামনে এগিয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি পিছিয়েছি।
আরো একটি আশ্চর্যজনক বিষয় লক্ষ করলাম। আমাদের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ক্লাসে উপস্থিতির জন্য নম্বর ৫ শতাংশ আর গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে ক্লাসে উপস্থিতির জন্য নম্বর হলো ১০ শতাংশ। অর্থাত্ যারা দুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে, বিজ্ঞানী হবে, আমলা হবে, ব্যাংকার হবে, তাদেরকেও ক্লাসে আসতে বাধ্য করা হয় এই ১০ নম্বরের লোভ দেখিয়ে। এবং এটা কাজও করে। আমি যেহেতু এই উপস্থিতির জন্য নম্বর পদ্ধতির বিপক্ষে, তাই আমি ক্লাসে উপস্থিতি নিতে বেশ অস্বস্তিতে ভুগি। আবার উপস্থিতির জন্য যেহেতু নম্বর আছে, তাই আমি নিতে বাধ্য। তবে আমি রোজ রোজ না নিয়ে দৈবচয়ন ভিত্তিতে মাঝে মধ্যে নিই।
আমি খাতাটা ওদের কাছে চালিয়ে দিই, ওরা নিজ দায়িত্বে কাজটি সেরে ফেলে। এতে আমার সময় বাঁচে। ক্লাসে ৫ মিনিট বেশি পড়াতে পারি। আমার প্রথম ক্লাসেই প্রায় ১৫-২০ মিনিটের বক্তব্যের মাধ্যমে এটার একটা ব্যাখ্যা দিই এবং বলি যে আশা করি তোমরা এই ব্যাপারে অসত্ হবে না। তবে কোনো একদিন আমি খাতায় উপস্থিতির সংখ্যা এবং সত্যিকারের উপস্থিতির সংখ্যা গুনব। তাই সাবধান!
সম্প্রতি আমি খাতায় উপস্থিতির সংখ্যা এবং সত্যিকারের উপস্থিতির সংখ্যা গুনে দেখি বিশাল গরমিল। রাগে, দুঃখে আমি নিজের প্রতিই বিরক্ত। বলতে বাধা নেই, ওই ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের আমি কেন জানি একটু বেশি ভালোবাসতাম। আর তারাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দিল। সামান্য একটা দিনের উপস্থিতি দেয়ার লোভ যে সামলাতে না পারবে, দুদিন পর তাদের ওপর রাষ্ট্র যে অনেক বড় দায়িত্ব দেবে, সেটা কীভাবে তারা সততার সঙ্গে পালন করবে? আমি জানি না এদের ক্লাস আমি আর স্বাভাবিকভাবে নিতে পারব কিনা। এরপর থেকে আমি শুধু এসব নিয়েই ভাবছি। দুশ্চিন্তা এখানেই, যারা এটুকু ক্লাস উপস্থিতি দেয়ার সুযোগ পেয়ে অসৎ আচরণ করেছে, পুরো দেশ ও জাতির ভবিষ্যত্ তো তাদের হাতেই। তারা স্বল্প সুযোগ থেকে আজ যে অন্যায় করেছে, ভবিষ্যতে এর থেকে বড় সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই আরো বড় কোনো ক্ষতি হবে তাদের দ্বারা। এটা ভেবেই দুদণ্ড স্বস্তির কোনো সুযোগ দেখছি না আপাতত।
রোল কল নিয়ে দুর্বৃত্তায়নের যে দুশ্চিন্তা, সেটা নতুন কিছু নয়। আসলে এগুলো আমাদের গোটা সমাজেই যে ঘুণে ধরেছে, তারই প্রতিফলন। কোথাও সততা নেই। চারদিকে অসৎ মানুষের জয়জয়কার। এই এরাই হয়তো ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়েছে। হয়তো এদের কাছের কেউ টাকা দিয়ে ফাঁসকৃত প্রশ্ন কিনে ওদের হাতে দিয়েছে। এরাই স্কুল টাইমে স্কুলে না গিয়ে কোচিং সেন্টারে গিয়েছে। শিক্ষক ক্লাসে কম পড়িয়ে কোচিং সেন্টারে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের বাধ্য করেছে। শিক্ষকের কাছে বুঝতে গেলে শিক্ষকরা টাকা ছাড়া বোঝাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বাজারে ভেজাল মেশানো খাবার দেখেছে। অর্থাত্ গোটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ অসততা। আমরা নাকি এগিয়েছি। অবশ্যই এগিয়েছি। এসব ক্ষেত্রে বিশ্বের সবাইকে পেছনে ফেলে আমরা সবার আগে। আমার সোনার বাংলা আজ সর্বক্ষেত্রে ক্ষতবিক্ষত।
আমি অনেক কিছুই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলার চেষ্টা করি। আর দৈনিকে লেখার ক্ষেত্রে গত্বাঁধা লেখার পথে না গিয়ে স্বাভাবিক ঘটন-বর্ণনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। যেমন বলতে পারি, দ্বিতীয় বর্ষের ল্যাবে “Verification of Faraday’s law” নামক একটি এক্সপেরিমেন্ট আছে। ছাত্ররা যখন এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে আমার কাছে আসে প্রথমেই যেই প্রশ্নটা করি, সেটা হলো Faraday’s law কী? প্রায় ৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পারে না। দ্বিতীয় বর্ষের ল্যাবে spectrometer দিয়ে বেশ কয়েকটি এক্সপেরিমেন্ট করি। ওটাতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের মাঝে একটি হলো টেলিস্কোপ। তখন প্রশ্ন করি: আচ্ছা, টেলিস্কোপ তো দূরের জিনিস দেখার জন্য তাই না? আমাদের ওই অপটিকস রুমটি তো খুবই ছোট। আর যেই জিনিসটি দেখার জন্য টেলিস্কোপ ব্যবহার করো, সেটি তোমার হাতের নাগালে। এত কাছের জিনিস দেখার জন্য টেলিস্কোপ ব্যবহার করো কেন? অনেক ছাত্রছাত্রীই এর সঠিক উত্তর দিতে পারে না।
আমরা কমবেশি জানি এ রকম আরো কিছু ছোটখাটো বিষয় আছে। অন্তত ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে যে কারো মনে এমন স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন আসতে পারে। প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়ে যারা নতুন কিছু করতে চায়, তাদের মনে অন্তত এ ধরনের প্রশ্ন আসা উচিত। যদি সে নিজে নিজেই এসবের উত্তর জানার চেষ্টা করে, তবে সেটা আরো ভালো। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের ছেলেমেয়েরা ল্যাব করে টেকনিশিয়ানের মতো, তারা কখনই খুদে পদার্থবিদের মতো চেষ্টা করছে এমনটা দেখি না। যদি কেউ করে থাকে, সেটা বেশ বিরল অভিজ্ঞতা। যা-ই হোক, ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করার আগে বাসায় একটু পড়ে আসা উচিত। বিশ্বের সব দেশে শিক্ষার্থীরা এটাই করে। পরিহাসের বিষয় হলেও সত্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ল্যাবের পড়ার জন্য ল্যাবের বাইরে সময় দেয়াকে তারা নিছক সময়ের অপচয় মনে করে। এটা থেকেই বুঝে নিতে কষ্ট হয় না আমাদের পুরো পড়াশোনাটাই কেমন যেন গলদপূর্ণ হয়ে ঘুরছে নৈরাজ্যের কানাগলিতে।
ছুটির প্রসঙ্গটাই ধরা যাক না, বিশ্বের অনেক দেশ সপ্তাহের মাঝখানে ছুটিগুলোকে রিশাফল করে উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে উইকেন্ডকে লম্বা করে নেয়। যেমন ১ মে যদি সোমবার না হয়ে মঙ্গল, বুধ ইত্যাদি হয়, তাহলে ১ মের ছুটি হবে সপ্তাহের প্রথম সোমবার যেন ছুটিটা মানুষ একটু উপভোগ করতে পারে। যেমন ২০১৮ সালের মে দিবসের ছুটি হবে ৭ মে সোমবার। কোনো কিছুতেই ওরা rigid না। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিগুলোকেও পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রিশাফল করে এমনভাবে তৈরি করেছে যেন ক্লাসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা শিক্ষাদানে ছন্দপতন না হয়। এখানে যা-ই হোক মূল উদ্দেশ্য ক্লাসের ধারাবাহিকতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। আবার যখন ছুটি হয়, সেটা যেন লম্বা হয় এবং ওই সময়টা যেন ছাত্র, শিক্ষক— সবাই কাজে লাগাতে পারেন। শিক্ষকরা সাধারণত বড় ছুটিগুলোয় হয় বেড়াতে যান, না হয় গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। আর আমাদের ছুটির কোনো মা-বাপ নেই। মৃত্যু দিবস, জন্ম দিবস, বিয়ে দিবস, যাওয়া দিবস, আসা দিবস অর্থাত্ দিবসের শেষ নেই। কোনো দিবসকে স্মরণ করার জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে সমগ্র দেশের মানুষ যদি যে যেইখানে যেই অবস্থাতেই থাকুক ১ মিনিট নীরবতা পালন করেও দিবসটি স্মরণ করা গেলে আমরা অনেকগুলো দিনকে কর্মদিবসে পরিণত করতে পারি। এত ছুটিবান্ধব দেশ পৃথিবীতে কমই আছে।
আশা এবং স্বপ্ন হন্তার দেশ বাংলাদেশ। এখানে একেকটি পরীক্ষা মানে mass killing of dreams! এখানে কেউ যদি কোনো কারণে এসএসসিতে খারাপ করে ফেলে, তার জীবন ওখানেই শেষ। আবার এসএসসিতে ভালো করেছে কিন্তু এইচএসসিতে খারাপ করে ফেলেছে, তার জীবন ওখানেই শেষ। আবার এসএসসি-এইচএসসিতে ঠিকই ভালো করেছে, কিন্তু অসুখ বা অন্য কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি বা ভালো করতে পারেনি, তার জীবনের সাফল্যের ওখানেই ইতি। এখন এসএসসিতে ভালো করেছে, এইচএসসিতে ভালো করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছে কিন্তু প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় খুব খারাপ করেছে, তার জীবনের সাফল্যের ওখানেই ইতি। এই দেশে সবাইকে দৌড়ের ওপর থাকতে হবে। দম নিতে একটু থেমেছ কি হেরেছ! এমন কি শরীর খারাপ হাওয়াও চলবে না।
অর্থাত্ জাগরণ এবং পুনর্জাগরণের সুযোগ এ দেশে নেই। এসএসসিতে খারাপ করেও এইচএসসি অনেক ভালো করে সফল হওয়া যায়, সেই সুযোগ এ দেশে নেই। কখনো কখনো এসএসসিতে ভালো করার পরও এইচএসসিতে খারাপ করে আবার ঘুরে দাঁড়ানো যায়, সেই সুযোগও বাংলাদেশে নেই। এসএসসি এবং এইচএসসি দুটোতেই খারাপ করে তার পরও কারো কারো জাগরণ ঘটতে পারে। কেউ কেউ কারো সান্নিধ্যে এসে হঠাত্ বুঝতে পারল পড়াশোনার মূল্য। সে তখন নতুন উদ্যমে শুরু করতে চায়। অথচ তাদের জন্য এই দেশে কোনো সুযোগ নেই। কারো কারো পারিবারিক আর্থিক অবস্থা এত খারাপ যে, এইচএসসি পাস করার পরই পরিবারের হাল ধরতে হয় এবং ধরেও। তার পর একসময় আর্থিক অনটন কেটে যায়। সে যদি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চায়, তার জন্য এ দেশ কোনো পথ রাখেনি।
একটি সভ্য দেশ মানেই সবার মাঝেই স্বপ্ন সফলের সম্ভাবনা নন-জিরো করে রাখা। সিস্টেম এমন থাকবে, যে কেউ যেকোনো সময় ইচ্ছা করলে আবার শুরু করতে পারে। পথটা হয়তো একটু কঠিন হবে, কিন্তু অসম্ভব নয়। অথচ এ দেশে কোনো কারণে কেউ এসএসসিতে খারাপ করে এইচএসসিতে ভালো এবং বিএসসি এমএসসি সব জায়গায় অসম্ভব ভালো করে MIT হার্ভার্ডে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য দরখাস্তেরই সুযোগ নেই। এসএসসিতে খারাপ করে যে কলঙ্কের তিলক একবার লাগিয়েছে, তার সম্ভাবনার দ্বার এই দেশে একদম বন্ধ হয়ে যায়। অথচ একটি মানুষ যদি এসএসসিতে মোটামুটি ভালো, এইচএসসিতে তার চেয়ে ভালো, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বিএসসি এবং এমএসসিতে উত্তরোত্তর ভালো করেছে, সে তো খুব ভালো। সে তো উন্নতির স্বপ্নসোপানে আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সে সুযোগ কোথায়। এখানে কুমিরের শিয়ালের বাচ্চা দেখানোর মতো একই সনদপত্র বারবার দেখিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়তে হয়।
শিক্ষা গবেষণাধর্মী, জীবনধর্মী-মননশীল নাকি কর্মমুখী হবে, সেটা ঠিক করতেই বেশির ভাগ সময় চলে গেছে আমাদের। আমরা এখন পর্যন্ত একটা গ্রহণযোগ্য, বস্তুনিষ্ঠ ও যৌক্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে পারিনি। অন্যদিকে সময়োপযোগী কোনো নীতিমালা প্রণীত হলে তার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েও সংশয় কাটেনি। বলতে দ্বিধা নেই একটি সভ্য দেশ হলে প্রতিক্ষেত্রে তার মূল্যায়ন হয় একটু অন্যভাবে, পরিহাসের বিষয় হলেও আমরা তা থেকে যোজন যোজন দূরে। নির্লজ্জতার শেষ সীমায় গিয়ে সবাইকে এক পাল্লায় একই ইয়ার্ড-স্টিকে মাপা আমাদের মুদ্রাদোষ। যা-ই হোক, অন্তত এ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। স্বপ্নকে জিইয়ে রেখে সেটাকে বর্ধনশীল করতে পারার পরিবেশ যে রাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ, তাকেই বলে স্বপ্ন হন্তারক। এখানে প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ নেই, ভুল শুধরানোর সুযোগ নেই, নতুন উদ্যমে শুরু করারও সুযোগ নেই। আর এটা যদি নাই থাকে, তবে অন্যসব খাতের পাশাপাশি শিক্ষায় যে নৈরাজ্য, তা রুখবে সাধ্য কার?
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়