দেশে বসেই যেভাবে সম্ভব আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা

দেশে বসেই যেভাবে সম্ভব আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা

  • শামসুল হক

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ। বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রেখেছে নাসডাক। আর আধুনিক শিল্পের নতুন যুগে প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতির দেশে–বিদেশি বিনিয়োগ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে সমান তালে এগিয়ে যেতে প্রয়োজন এমন এক দক্ষ জনশক্তি, যাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা ও অভিজ্ঞতা।

আর এ প্রয়োজন পূরণের তিনটি উপায় রয়েছে।

প্রথমত, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবাসীদের দেশে কাজের সুযোগ করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে নানা অসুবিধাও রয়েছে। প্রবাসী কর্মীদের বেতন দিতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ ঘটে। কর্মসংস্থানের সুযোগ হারায় দেশের জনসংখ্যা।

দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়াতে তরুণদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। দীর্ঘ মেয়াদে এ কৌশলও খুব একটা কার্যকর নয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা তরুণেরা দেশে না–ও ফিরতে পারে, উচ্চশিক্ষা শেষ করে বিদেশেই তাঁরা ভালো চাকরি জুটিয়ে নেবেন। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় পরিশোধ করতে হবে; পাশাপাশি তাঁদের জীবনধারণের ব্যয়ও রয়েছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যয় মেটাতে দেশে শিক্ষার্থীর পরিবারকে সম্পত্তি বন্ধক দিতে হতে পারে কিংবা জমানো সঞ্চয়ে হাত দিতে হবে। আবার, জাতীয়ভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহও বন্ধ হবে না।

অথচ উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালে ইউনেসকো জানিয়েছে, প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতক শেষ করতে কম করে হলেও তিন বছর লাগে। এ হিসেবে অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনা করছেন। পশ্চিমা বিশ্বে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীর স্নাতক করতে গড়পড়তা খরচ প্রায় ২০ হাজার মার্কিন ডলার। স্নাতকোত্তর করলে খরচ আরও বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীপিছু ২০ হাজার ডলার ধরলে তিন বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যায়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এটি কোনো কার্যকর কৌশল নয়।

তাহলে বাকি থাকে তৃতীয় পন্থা, শিক্ষার্থীদের জন্য দেশেই সাশ্রয়ী খরচে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। সরকারি-বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনের মাধ্যমে দেশে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক সেন্টার চালু করে এটা করা যায়। এটা করলে উল্লেখিত বার্ষিক ১২০ কোটি মার্কিন ডলারই শুধু সঞ্চয় হবে না, পাশাপাশি আরও দুটি উদ্দেশ্য পূরণ হবে। আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়ন হবে, শিক্ষাদান ও গবেষণার মান বাড়বে, পাশাপাশি বৈশ্বিক শিক্ষা আত্মীকরণের মাধ্যমে বাইরেও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। তবে, এ ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। দেশে আন্তর্জাতিক একাডেমিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হবে। অনেক ক্ষেত্রেই এটা হবে বিদেশি বিনিয়োগ। দেশের নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। অলাভজনক ট্রাস্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা যাবে না; কেননা, বিনিয়োগকারীরা ইস্যুকৃত শেয়ারের বিপরীতেই ইকুইটি বিনিয়োগ করে। আশার কথা, দূরদর্শিতার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ওপরের সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

উচ্চশিক্ষা আন্তর্জাতিকীকরণে সরকারের তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধিত ২০১০), বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ও স্টাডি সেন্টার বিধিমালা–২০১৪ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষার কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৮-২০৩০ (এসপিএইচই ২০১৮-২০৩০)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পরিকল্পনা উন্মোচনকালে বলেন: এসপিএইচই: ২০১৮-৩০ দেশের মানবসম্পদকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের একটি পদক্ষেপ। দেশের উচ্চশিক্ষাকে বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে এ কৌশল বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

এসপিএইচই ২০১৮-৩০–এ স্পষ্টভাবেই বলা আছে: ‘বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; কেননা, অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে দেশেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিকল্প হিসেবে সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে শাখা খোলার অনুমোদন দিতে পারে, যা দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে। বিশ্বায়নের যুগে, আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ না দেওয়া হলে এর বিপরীত বিষয় ঘটতে পারে।’

এসব বিবেচনায় সরকার সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন কলেজের স্টাডি সেন্টার পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে। সেখানে সেই কলেজের আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হবে। পরীক্ষা ও শিক্ষাদান হবে মূল ক্যাম্পাসের তত্ত্বাবধানে। এ ধরনের স্টাডি সেন্টার শুধু দেশের শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগই করে দেবে না, পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় শিক্ষকদের মানোন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ও একই মডেলে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিতে পারে।

উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হয়ে উঠতে বাংলাদেশের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। তবে এ যাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে সরকারের গৃহীত সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উন্মোচনে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ড. শামসুল হক সাবেক পরিচালক, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক উপাচার্য, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

Sharing is caring!

Leave a Comment