মেধাপাচার থামাবে কে ?
- এস এম নাদিম মাহমুদ
ইংরেজিতে ব্রেন ড্রেন শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো মেধা পাচার। আর বৈশ্বিক সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, যখন কোনো দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ পেশাজীবীরা ভালো বেতন ও উন্নতমানের জীবন যাপনের আশায় উন্নত দেশগুলোতে গিয়ে আর নিজ দেশে ফিরে আসে না, তখন সেটাকে আমরা মেধা পাচার হিসেবে দেখি।
বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কোম্পানিগুলোতে আমাদের দেশের মেধাবী সন্তানরা নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে ফ্যাকাল্টি পদ পাওয়ার কয়েক বছর কিংবা কয়েক মাস পরই বিদেশে স্নাতকোত্তর কিংবা ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য যায়। এই শিক্ষকদের সিংহভাগই দেশের বাইরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। অথচ এই মেধাবীদের প্রধান দায়িত্ব ছিল, উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া। কৃষক, তাঁতি, রিকশাচালকদের দেওয়া আয়করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার যে সুযোগ মিলেছিল তার ঋণ শোধবার চেষ্টা করা। কিন্তু না, আমরা তা পারছি না। একের পর এক আমরা তরুণ মেধাবীদের হারিয়ে ফেলছি।
মেধা পাচার শুধু যে বাংলাদেশ থেকে হচ্ছে তা নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ব্রেন ড্রেন একটি কর্কটরোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞান সাময়িকী ‘পলস ওয়ান’ মতে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর প্রায় চল্লিশ শতাংশ বিদেশি। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ চীন থেকে আসা। তুলনামূলক কম অর্থের স্কলারশিপে এশিয়ান দেশগুলোর মেধাবী ছেলেমেয়েদের ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেকটা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো প্রথম দিকে তাদের অর্থনৈতিক অপচয় মনে করলেও এই মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে গবেষণার জন্য যৌথ ফান্ড ব্যবস্থা করে আয়কর জমা করছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
বৈশ্বিক উন্মেষের কারণে ‘মেধা পাচার’-এর জন্য মূলত তিনটি অনুষঙ্গ প্রকট। প্রথমত, অথনৈতিক সচ্ছলতা, দ্বিতীয়ত, মেধার সঠিক মূল্যায়ন এবং তৃতীয়ত, সামাজিক পারিবারিক ও চিকিৎসার নিরাপত্তা। তাহলে মেধা পাচার হলে আমাদের সমস্যা কী? তারা তো বেশ স্বাচ্ছন্দময় জীবন যাপন করছে। আবার দেশে রেমিটেন্সও পাঠাচ্ছে। কিন্তু আল্টিমেট ফলাফল কী দাঁড়াচ্ছে?
আমাদের দেশে চাষযোগ্য জমিগুলোতে তিনটি স্তর থাকে—টপ লেবেল, মিডিল আর লওয়ার। একজন কৃষক যখন ফসল ফলায় সে চেষ্টা করে টপ লেবেলে ফসল ফলাতে। কারণ এই উচ্চ স্তরে জমির গুণাগুণ ঠিক থাকে। কেউ যদি উচ্চ স্তরটিকে কেটে নেয়, তাহলে মধ্যম স্তরে এসে ফসল মার খেয়ে যায়। আমরা এখন মধ্যম স্তরের মেধার চাষাবাদ করছি।
বাংলাদেশ এখন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব জায়গায় মেধা শূন্যতায় ভুগছে; যার ফলাফল আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি। কলা কিংবা বাণিজ্য অনুষদ থেকে পাস করে বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের গবেষণা দেখভালের দায়িত্বে থাকছে। যাদের কি না বায়োলজি কিংবা রাসায়নিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা শূন্যের কোঠায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের, সেখানে তারা রাজনীতি চর্চা করছে। চিন্তাশীল মানুষের অভাব দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে। এক সময়ের তুখোড় প্রবীণরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পূরণ হচ্ছে না তাঁদের স্থান। অথচ আগের চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী সন্তান বাংলাদেশ গড়ে তুলছে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, ডাক্তার থেকে শুরু করে সর্বত্র বিশ্ব নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দক্ষ মানব সম্পদ বাংলাদেশের আছে। কিন্তু ‘মেধা পাচার’ ট্রাফিকে পড়ে আমরা আমাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও স্বীকৃতিগুলো হারাতে বসেছি।
আমাদের কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলাদেশ পেতে হলে প্রবাসে থাকা তুখোড় মেধাবী বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। সারা বিশ্বই যেখানে তাদের উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া মেধাবীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করছে সেখানে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে যাবে?
লেখক: শিক্ষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান