নারী উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ
- লায়ন মোমিন মেহেদী
আমাদের নারী সমাজের একটি বিশাল অংশ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য ভূমিকা রাখার যোগ্যতা ও মেধা রাখলেও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকায় পিছিয়ে পড়ছে প্রকৃত নারী উদ্যোক্তারা। আমাদের অর্থনীতির রঙিন সময় গড়ে তুলতে হলে সরকারকে হতে হবে বাংলাদেশের সকল নারী উদ্যোক্তার জন্য আরো আন্তরিক। সুন্দর পরিপাটি অর্থনীতি গড়তে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পেক্ষাপটেও একটি কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে, আর কথাটি হলো- আমাদের অর্থনীতির একটা মজবুত ভিত্তি গড়ে ওঠার পেছনে মূলত শ্রমিকরাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধিশালী করতে এখন অনেক দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠান ও কর্মসূচিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বৃহত্তর শ্রম সংস্থান গার্মেন্টের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। নারী শ্রমিকদের কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে তৈরি পোশাক শিল্পের এই বৃহত্তর মার্কেট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়াও নারীর এই শ্রমের বিনিময়েই বৈদেশিক মুদ্রা আসছে বাংলাদেশে। যা আমাদের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করছে।
শুধু দেশে নয়, নারীরা এখন দেশের বাইরে গিয়েও কাজ করেন। পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর এই অংশগ্রহণ আমাদের অর্থনীতিতে এক বিশাল সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের অন্য সব দেশের অর্থনীতির সমপর্যায়ে নিয়ে আসতে কিংবা সেসব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে নারীদের আরো উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা উদ্যোক্তা হিসেবেও শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরিতে আগ্রহী হন। এতে করে গড়ে উঠবে বাংলাদেশের নারীবান্ধব বর্তমান। যেখানে নারীদের হাতের ছোঁয়ায় আরো শক্তিশালী ও মজবুত হবে বয়ে চলা অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনীতির মূল ধারায় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু নারীদের এ বিষয়ে অংশগ্রহণের বাস্তবতা খুবই কম। এর পেছনেও নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা অনেকটাই অবহেলিত। তাছাড়াও নারী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা শঙ্কা।
এই শঙ্কা কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নারী ব্যবসায়িক উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ পরিচালনায় ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নারী উদ্যোক্তাদের কৃষি ও এসএমই ঋণ বিতরণে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই স্কিমের আওতায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সুদে নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। এই ঋণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে শুধু ব্যক্তিগত গ্যারান্টির জামানত হিসেবে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা প্রদান করবে। এরই মধ্যে এই স্কিমের আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ২০১০ সালে প্রায় ১৮০৫ কোটি টাকা এবং ২০১১ সালে প্রায় ২০৪৮ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করে। ২০১২ সালের এই সময়ের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে প্রায় ১১২৯ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
সরকারের এই সহজ শর্তে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানের কারণে নারীদের মধ্যে উৎসাহ বেড়েছে। অনেক নারীই এখন উদ্যোগী হয়েছেন একটা কিছু করতে। ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার নারী উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ঋণকৃত এই অর্থ দিয়ে তারা নিজেদের স্বাবলম্বী করার জন্য ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যা শুধু তাদের জীবন থেকে দারিদ্র্য নামের অভিশাপ দূর করেনি; দেশের অর্থনীতিতেও সূচনা করেছে নবউদ্যমের কিংবা নবযুগের। যার প্রভাব বিস্তার করছে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে। তাই নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সহায়তা করতে হবে। সেই সঙ্গে অবহেলিত উৎপাদনমুখী খাতগুলো সচল করার প্রচেষ্টায় নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে যাতে করে বরিশালের মাহমুদা বা রাধার মতো করে গড়ে ওঠে প্রতিটি জেলা উপজেলা আর ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তা-নারী উন্নয়ন শক্তি।
আমাদের প্রিয় নারী সমাজের মান নিয়ে এগিয়ে চলা মাহমুদা ও রাধার কথা বলছি এজন্য যে, তারা তাদের বয়স বা আর্থিক কথা না ভেবে বয়ে চলেছেন পদ্মা নদীর মতো। জানা যায়, বরিশালের মাহমুদা ও রাধা রানী ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে ছোট প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি অন্যদের কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখছেন। নগরীর অমৃত লাল দে সড়কের নতুন বাজার এলাকায় মেসার্স রাধা বস্ত্রালয় নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী রাধা রাণী ঘোষ। মাত্র এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করা রাধা রাণীর স্বামী ছোট একটি রেস্তোরাঁ চালাতেন। সংসারে টানাটানি ঘোচাতে রাধা রানী প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। ঘটনাক্রমে ভাইয়ের সাথে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবাজার থেকে কয়েকটি শাড়ি কিনলেন নিজের ও প্রতিবেশীদের জন্য। শাড়িগুলো খুব পছন্দ হলো তাদের। আর সেখান থেকেই ঘুরে গেল রাধা রানীর জীবনের মোড়। ঢাকা থেকে শাড়ি কিনে ঘরে বসেই বিক্রি করতে শুরু করলেন। টিউশনি ছেড়ে শাড়ি ও বাচ্চাদের পোশাকের একটি দোকান দিলেন। ব্যবসার সমপ্রসারণের জন্য বেসিক ব্যাংক, বরিশাল শাখা থেকে ২ লাখ টাকা এসএমই ঋণ নেন। পরে আরো ৩ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন।
নগরীর হাটখোলা মসজিদ রোড এলাকার মাহমুদা বেগম আরেক সফল নারী উদ্যোক্তা। তিনি এইচএসসি পাসের পর সাংসারিক ঝামেলায় আর পড়াশোনা হয়নি। স্বামী-শ্বশুরসহ আত্মীয়স্বজন স্ক্রাপ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ব্যবসায় মন্দা শুরু হলে মাহমুদা গড়ে তোলেন মেসার্স শাওন ট্রেডার্স নামে প্রতিষ্ঠানটি। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে চিপস বানিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানায় সরবরাহ করেন তিনি। মাহমুদা বেগমের এ প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে সিটি ব্যাংক, বরিশাল শাখা থেকে ৮ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। মাহমুদা বেগম আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সুপরিচিত। এই পরিচয়, এই উদ্যোগ, এই সাধনাকে আরো এগিয়ে নিতে সরকারের সকল পর্যায় থেকে সঠিকভাবে নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা নিয়ে ভাবা উচিৎ। নারী সমাজ ইচ্ছা করলেই সুন্দর করে সাজাতে পারেন দেশ, মাটি এবং মানুষের বর্তমান। এজন্য চাই সঠিক সহায়তা, সঠিক স্বপ্ন এবং সঠিক বাস্তবায়ন।