আগে চাই কর্মসংস্থান পরে উচ্চশিক্ষা
- জাজাফী
রূপকথার গল্পের মত বলতে হয়, সে বহুকাল আগের কথা। এদেশের মানুষ লেখাপড়া শিখতো জ্ঞানার্জনের জন্য কিন্তু এখন আমরা লেখাপড়া শিখি একটা ভালো চাকরির আশায়। আমাদের দেশে লেখাপড়া, উচ্চতর ডিগ্রি সবই মূলত একটি ভালো কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনটা শ্রেয়? উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন নাকি দ্রুততম সময়ে স্বাবলম্বী হওয়া? আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশে পারিবারিক টানাপড়েনের মধ্যে প্রতিটি পরিবার চায় তাদের সন্তান শিক্ষিত হোক। কিন্তু সেই শিক্ষিত হোক কথাটিকে সত্যে পরিণত করতে গিয়ে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
সম্প্রতি আমার পরিচিত অনেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭৮তম দীর্ঘমেয়াদী কোর্সে জয়েন করেছে এবং আপনি শুনলে অবাক হবেন তাদের সিংহভাগই এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেয় এবং ইতোমধ্যে যাদের ফলাফলও বের হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার আগেই তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি চাকরি পেয়েছে যা তাদের জীবনকে আমুল বদলে দিচ্ছে। পাশাপাশি তাদেরই বন্ধুরা এখন দিনরাত অবিরাম পরিশ্রম করছে কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন একটা বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার জন্য। যারা সেনাবাহিনীতে কিংবা অন্য কোন বাহিনীতে কিংবা মনে করি কোন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কোন পদে চাকরি নিয়েছে তাদের বেতন ধরে নেওয়া যেতে পারে মাত্র দশ থেকে পনের হাজার টাকা। পক্ষান্তরে যারা দেশের সব থেকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে সেরা বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেলো, তাদের মধ্যে অনেক কিছুর পার্থক্য গড়ে উঠবে। একজন হয়তো লেখাপড়া করে অনেক ভালো রেজাল্ট করবে এবং তাকে সে জন্য চার থেকে ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। তার পর সে একটা চাকরি পাবে এবং ধরে নেওয়া যেতে পারে তার বেতন হবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে আমাদের যে বন্ধু সাধারণ একটা প্রতিষ্ঠানে হয়তো সেলস ম্যানের চাকরি নিয়েছিল এইচএসসি পরীক্ষার পরই সে এই ছয় বছরে কয়েক লাখ টাকার মালিক হয়ে যাবে যা তাকে এবং তার পরিবারকে আমার তুলনায় অনেক বেশি সুখ এনে দিতে সক্ষম।
আমার এক বন্ধু সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক পদে জয়েন করে এবং চাকরি জীবনে সে জাতিসংঘে মিশন করে এসেছে। ওই মিশন থেকে সে যে আর্থিক সুবিধা লাভ করেছে তা আমি আইবিএ থেকে পাস করে ঠিক কতদিনে অর্জন করতে পারব তা কি আপনি অনুধাবন করতে পারবেন? ধরুন আমি আইবিএ থেকে ভালো সিজিপিএ নিয়ে পাস করে দেশের বড় কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো পদে চাকরি পেলাম এবং শুরুতেই আমাকে পঞ্চাশ হাজার বা তারও বেশি বেতন দেওয়া হলো। তার পরও দেখা যাবে আমার যে বন্ধু জাতিসংঘ মিশন করে এসেছে তার অর্জিত সম্পদের সমান আয় করতে আমাকে কয়েক বছর পার করতে হবে। আদতে যদিও কথাটা সেরকম নয়। কেননা আপনি যত উঁচু পদের চাকরি করবেন আপনার ব্যয়ও ততধিক হবে। ফলে খরচের পর খুব বেশি জমাতে পারবেন বলে মনে করি না।
বুয়েট, আইবিএ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিষয়গুলো বাদ দিলে বাকি সব ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করলে বেশ হতাশ হতে হয়। তারা প্রতি বছর ভালো ফলাফল করে পাঁচ ছয় বছরে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যায় কিন্তু চাকরি হয় না। ফলে দেখা যায় এইচএসসির পর মূলত সে একটা কর্মসংস্থান করতে প্রায় নয় থেকে দশ বছর পার করে ফেলে। যে সময়টাতে অন্য বন্ধুরা, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগই পায়নি কিংবা চেষ্টাও করেনি বরং কাজে নেমে পড়েছে তার অর্জিত সম্পদ তখন দেখার মতো।
এতসব কথা বলার মানে এই নয় যে, আমি উচ্চশিক্ষার পক্ষে নই। আমিও চাই দেশের প্রতিটি নাগরিক উচ্চশিক্ষিত হোক। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে, পারিবারিক দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে আমার মনে হয়েছে উচ্চশিক্ষার চেয়ে দ্রুত কর্মসংস্থান অধিক জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে দ্রুত কর্মসংস্থান কিভাবে সৃষ্টি হবে? চিন্তা করে দেখুন বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তাদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। দেশের ভিতরেই যারা হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে জমিয়ে বিলিয়নিয়ার তকমা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের উন্নতির জন্য, দেশ থেকে বেকারত্ব কমানোর জন্য এবং অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য মূলত ওইসব টাকাওয়ালাদের সদিচ্ছার খুবই প্রয়োজন। ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা জমিয়ে না রেখে সেগুলো সঠিকভাবে বিনিয়োগ করলে, নতুন শিল্প কারখানা তৈরি করলে এ দেশের অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হতো।
সরকার চাকরির বয়স বাড়াবে না বলে তাদের সিদ্ধান্তকে খুঁটির সাথে শক্তভাবে বেঁধে রেখেছে। অন্য দিকে, পযার্প্ত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হলেও সে পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় ক্রমাগত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশ একদিন বেকারদের ভারি নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠবে। দেশকে উন্নত করতে হলে সবার আগে চাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত তৈরি করে লাভ কী? এখনই আমাদের আফসোস করতে হচ্ছে, যে পরিমাণ শিক্ষার্থী এ প্লাস নিয়ে পাস করছে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সুযোগ দিতে পারছি না আর সেসব শিক্ষার্থীরা যখন কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বের হবে তখন তাদেরকে আমরা কোথায় রাখবো? শিক্ষার্থীরা হলো ফসলের মতো। আপনি অনেক ফসল উৎপাদন করলেই হবে না বরং সেগুলো যত্ন করে রাখার মতো ব্যবস্থাও করতে হবে। তাই সবার আগে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারলে তবেই আমাদের উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছার স্বপ্ন সত্যি হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়