শুভ জন্মদিন নায়করাজ
বিনোদন ডেস্ক : রাত ১২টা ১ মিনিট মানে শনিবারের প্রথম প্রহর। জীবনের হীরক আলোয় উদ্ভাসিত হলেন ‘বেহুলা’র লখিন্দর। ৭৫তম জন্মদিন স্পর্শ করলেন এ চলচ্চিত্র কিংবদন্তি। তিনি নায়ক রাজ্জাক। খ্যাতিমান সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরীর কলমে সেই যে ‘নায়করাজ’ বিশেষণ বেরিয়ে এসেছিল তা কালের বিবর্তেও থেকে যাবে মানুষের হৃদয়ে ও ইতিহাসের পাতায়।
১৯৪২ সালে রাজ্জাক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বরসতী পূজা চলাকালীন মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার ‘গেম টিচার’ রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহী’তে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়ক রাজের অভিনয়ে প্রবেশ। সেই যে অভিনয়ের সঙ্গে বাঁধা পড়ল জীবন তা আজ ফুলে-ফলে শোভিত পূর্ণ বৃক্ষ।
টুকরো অভিনয় জীবন
- স্কুলে পড়ার সময় ‘বিদ্রোহ’ নাটক আর কলেজে ‘রতন লাল বাঙ্গালি” ছায়াছবিতে তার প্রথম অভিনয়।
- ১৯৫৯ সালে বোম্বের ফিল্ম আলয়ে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার ‘পংকতিলক’ এবং ‘শিলালিপি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়।
- ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। প্রথমদিকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি যোগাযোগ করেন ঢাকায় প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি রাজ্জাককে ওই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মসে চাকরি নিয়ে দেন। চাকরিটি হচ্ছে পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারীর কাজ। সহকারী পরিচালক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘উজালা’।
- সহকারী পচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘আখেরী টেনশন’ ও ‘ডাক বাবু’ ছবিতে তিনটি ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। সালাউদ্দিন প্রোডাকশনের ‘তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগর লেন’ চলচ্চিত্র ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। ছোট চরিত্র হলেও নজর কাড়েন তিনি।
- বরেণ্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। কালজয়ী নির্মাতা জহির রায়হানের ’বেহুলা’ চলচ্চিত্রে ১৯৬৬ সালে নায়ক হিসেবে তার যাত্রা শুরু। চার দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি সিনেমা।
- অভিনয়ের পাশাপাশি নায়ক রাজ রাজ্জাক ১৯৭৬ সালে ‘আশঙ্কা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গড়ে তোলেন প্রযোজনা সংস্থা এমএস প্রোডাকশন। এ পর্যন্ত ২০ টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন তিনি।
- এ পর্যন্ত পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।
- এখনও অভিনয় করে চলেছেন। দাফন-কাফন নামে একটি প্রামাণ্য চিত্রের ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ নায়ক রাজের মৃত্যুর পর সম্পন্ন করা হবে।
পরিবার ও জন্মদিন পালন : টালিগঞ্জের মোল্লাবাড়ির আকবর হোসেন ও মিনারুন্নেসার ছোট ছেলে আবদুর রাজ্জাক মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন খায়রুন্নেসাকে। ভালোবেসে যাকে তিনি ৫৩ বছর ধরে ডেকে আসছেন লক্ষ্মী নামে। তার সাফল্যের লক্ষ্মী। নায়করাজ প্রতিবছর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে গুলশানের নিজ বাসভবন ‘লক্ষ্মীকুঞ্জে’ ঘরোয়াভাবে জন্মদিন পালন করে থাকেন। ৭৫তম জন্মদিনও তেমন করেই কাটছে তার। নায়ক রাপ্পারাজ ও সম্রাটসহ তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
বাকী যত আয়োজন : জন্মদিনে প্রথমবারের মতো তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে গান। যাতে কণ্ঠ দিয়েছেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী, বাপ্পা মজুমদার ও আঁখি আলমগীর। তোমার আলোয় পৃথিবীটা আরও রঙিন হলো/ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তুমি স্বপ্ন প্রদীপ জ্বালো/ তোমার কাছে রয়ে গেল আমাদের অনেক ঋণ/ আজ তোমার জন্মদিন… এমন কথার গানটি লিখেছেন ওমর ফারুক। সুর-সংগীতায়োজন করেছেন বাপ্পা মজুমদার। নায়করাজকে উৎসর্গ করা গানটি শুক্রবার প্রকাশ পেয়েছে ইউটিউবে।
চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি অভিনেতার জন্মদিন উপলক্ষে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আই শুক্রবার রাত থেকে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করছে। শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় ‘গানে গানে সকাল শুরু’ অনুষ্ঠানে রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রের গান করবেন দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম ও আব্দুল জব্বার। বেলা ১১টা ৫ মিনিটে প্রচার হবে ‘নায়করাজের চার যুগ। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী। পরিচালনা করেছেন আবদুর রহমান। একই দিন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে ‘এবং সিনেমার গান’ অনুষ্ঠানে থাকবে রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রের গান। দুপুর সাড়ে ১২টায় ‘সিটিসেল তারকাকথন’ অনুষ্ঠানের অতিথি থাকবেন রাজ্জাক। বেলা আড়াইটায় দেখানো হবে রাজ্জাক অভিনীত ‘অশিক্ষিত। ছবিটি পরিচালনা করেছেন আজিজুর রহমান।
পুরস্কার ও অন্যান্য
এ পর্যন্ত মোট পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ছবিগুলো হলো- কি যে করি (১৯৭৬), অশিক্ষিত (১৯৭৮), বড় ভাল লোক ছিল (১৯৮২), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), যোগাযোগ (১৯৮৮)। চ্যানেল আই আয়োজিত চলচ্চিত্র মেলা-২০০৯ চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য পুরো নায়ক রাজ রাজ্জাকের পরিবারকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়া বাচাসাসসহ বহু সংগঠনের অসংখ্য পদক জয় করেছেন নায়ক রাজ রাজ্জাক। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘ (ইউএনএফপিএ) এর বিশেষ দূত হিসেবে পালন করেছেন। এই দায়িত্বে তিনি নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে কাজে করেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ‘রংবাজ’ চার দশকের পথ পরিক্রমায় সিনেমার ‘আলোর মিছিল’ ধরে হয়ে উঠেছেন আপন আলোয় হীরকময়, মহীরুহ। শুভ জন্মদিন নায়করাজ।