বাংলা চলচ্চিত্রের হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র সালমান শাহ
- সানজিদা হোসেন
৯০ দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ। বাংলা সিনেমায় যাকে সর্বকালের সেরা নায়ক বলা হয়। তিনি তাঁর অভিনয় দক্ষতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সংলাপ বলার ধরন সব কিছু মিলিয়ে স্থান করে নিয়েছেন হাজারো মানুষের হৃদয়ে।
জনপ্রিয় এই নায়কের প্রকৃত নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সালমান শাহ্ ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান সিলেটের জাকিগঞ্জে দাড়িয়াপাড়ায়। তার বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী এবং মা নীলা চৌধুরী। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। তিনি আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন এবং ধানমন্ডি মালেক সায়েন্স কলেজ থেকে বি. কম পাশ করেন। ১৯৯২ সালের ১২ই আগস্ট সামিরা হকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন তিনি ।
ছোটবেলায় ক্রিকেটের প্রতি বেশ ঝোঁক থাকলেও স্কুল জীবনের বন্ধুদের উৎসাহে পদার্পণ করেন অভিনয় জগতে। ছোটপর্দায় অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর অভিনয় জগতের যাত্রা শুরু হয়। কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবেও। ১৯৯০ সালে পদার্পণ করেন বাংলা চলচ্চিত্রে এবং তাঁর কাজের মাধ্যমে খুব কম সময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌছান এই অভিনেতা। চলচ্চিত্র জগতে দুর্দান্ত অভিনয় করে ইমন থেকে হয়ে উঠেন সালমান শাহ।
১৯৯৩ সালে তাঁর সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” চলচ্চিত্রটি দর্শক মনে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সিনেমাটি যেমন বেশ ব্যবসা সফল হয় একই সাথে তাঁর জনপ্রিয়তার দ্বার উন্মুক্ত করে। সালমান শাহের প্রথম সিনেমাটি মুক্তির পরই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি । খুব দ্রুত পরিচালক ও দর্শকদের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তাঁর অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে। তাঁর আবির্ভাবে বাংলা চলচ্চিত্র একটি ভিন্ন ধারা খুঁজে পেয়েছিল। অনেকে আবার তাঁর মধ্যে বলিউডের নায়কদের ছায়াও খুঁজে পেয়েছিলেন।
নব্বই দশকে সাড়া জাগানো এই নায়ক সর্বমোট ২৭টি সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন। সালমান শাহ অভিনীত সবকটি সিনেমাই ব্যবসা সফল হয়েছিল। তাঁর মধ্যে ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘অন্তরে অন্তর’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘সত্যের মৃত্যু ‘, ‘তোমাকে চাই’, ‘আশা ভালোবাসা’, ‘দেন মোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ অন্যতম। মাত্র চার বছরে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
তিনি তাঁর প্রথম সিনেমায় জুটি বেঁধে ছিলেন অভিনেত্রী মৌসুমির সাথে । পরে শাবনূর, শাবনাজ, বৃষ্টি, শিল্পী, লিমার সাথেও জুটি বেঁধে ছিলেন। তবে শাবনূর-সালমান জুটিই দর্শকদের মনে দাগ কেটে ছিল। বক্স অফিসে এই দারুন জুটির ১৪টি সিনেমা বেশ সাফল্য লাভ করে ছিল। অভিনয় জগতের তার বিচরনকাল খুব একটা বেশি ছিল না। কিন্তু কম সময়ে সাড়া জাগিয়েছে তার অভিনীত প্রত্যেকটি চলচ্চিত্র।বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা অভিনেতা সালমান শাহ; সৌন্দর্য্য এবং নিজস্ব স্টাইলের জন্য তিনি ছিলেন হার্টথ্রব অভিনেতা। পরিচয় মিলে চলচ্চিত্রের “রোমান্টিক হিরো” হিসেবে ।
কিন্তু হঠাৎই থমকে যায় এই হার্টথ্রব অভিনেতার জীবন। ১৯৯৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকার ইস্কাটনে তাঁর নিজ বাস ভবনে সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, পারিবারিক কোলাহলের কারনে আত্নহত্যা করেন এই মহানায়ক। ময়নাতদন্তে আত্নহত্যার কথা উল্লেখ করা হলেও তার মৃত্যুর রহস্য আজও ঘোলাটে তার ভক্তদের কাছে ।
মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে আলোচনা থেমে থাকেনি। পরিচালক, প্রযোজক, দর্শক সবাই এই জনপ্রিয় নায়কের অভাব এখনো অনুভব করেন। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তার চলে যাওয়ায় যে অভাব সৃষ্টি হয়েছিল তা সত্যিই অপূরনীয়। তাঁর চুলের স্টাইল, পোশাক -পরিচ্ছদ এখন অনেক নায়ক অনুকরন করেন। তাঁকে ‘আইডল’ হিসেবে মানেন হাজারো মানুষ। অনেকের কাছে তিনি আবার স্বপ্নের নায়ক কিংবা স্বপ্নের মানুষ।
মৃত্যুর ২৪ বছর পরও ভক্তদের কাছে একটি বড় রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে এই মহানায়কের মৃত্যু। অকাল প্রয়াত এই অভিনয় শিল্পী চলে গিয়েও রয়ে গেছেন হাজারো ভক্তের মনে। প্রতিবছরই জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর ভক্ত, চলচ্চিত্রপ্রেমীরা তাকে স্মরণ করেন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে। সালমান শাহ অমর হয়ে আছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ।