পর্দার আড়ালের ‘জিন ডেইচ’

পর্দার আড়ালের ‘জিন ডেইচ’

  • শ্রেয়সী সরকার

পর্দার আড়ালের নক্ষত্র ‘জিন ডেইচ’ নামটি আমাদের অনেকের কাছেই অপরিচিত। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি ‘টম এন্ড জেরি’ আমাদের সকলের ছোটোবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু! অ্যানিমেটেড চরিত্র দুইটি যাঁদের কল্যাণে সকলের কাছে সর্বদা জীবন্ত থাকবে তাঁদের মধ্যে একজন ‘জিন ডেইচ’।

পুরো নাম ইউজিন মেরিল ডেইচ হলেও তিনি জিন ডেইচ নামেই বেশি পরিচিত। ১৯২৪ সালের ৮ই আগস্ট শিকোগোতে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান নির্মাতা। তিনি একাধারে একজন চিত্রকার, অ্যানিমেটর, কমিক্স শিল্পী এবং চলচ্চিত্র পরিচালক। তাঁর পিতা জোসেপ ডেইচ পেশায় একজন সেলসম্যান এবং মাতা রুথ ডেলসন ডেইচ গৃহিনী। সামান্য একজন সেলসম্যানের সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়ার পরও তিনি বেছে নেন শৈল্পিক জীবন। ১৯২৯ সালে নিজের পরিবার ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসেন জিন। তিনি হলিউডের একটি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন এবং পরবর্তিতে লস এঞ্জেলেস হাই স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে পাস করেন। ছোটোবেলা থেকে তিনি সৃজনশীল চিত্র তৈরি করতেন, যা পরবর্তীতে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন।

ছোটোকাল থেকেই চিকিৎসক হবার স্বপ্ন ছিলো জিন ডেইচের। কিন্তু ১৯৪৪ সালে মেডিকেল পরীক্ষায় অসফল হয়ে সেই স্বপ্নকে ভুলে শিল্প জগতে প্রবেশ করেন তিনি। প্রথমে নর্থ আমেরিকান এভিয়েশনে নকশাকার হিসাবে চাকরী জীবন শুরু করেন জিন। এছাড়াও তিনি সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর পাইলট হিসেবেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তবে স্বাস্থ্যগত কারণের জন্য ১৯৪৪ সালে তাঁর সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে হয়। এরপর থেকে তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়, শুরু হয় তার শিল্পী জীবন। প্রবেশ করেন অ্যানিমেশনের দুনিয়ায়।

১৯৫৮ সালে তাঁর সৃজনশীল কাজের জন্য তিনি অনন্য সফলতা লাভ করেন। সেই সময়ই ‘সিডনিস ফ্যামিলি ট্রি’ সিনেমার কারণে অস্কারের জন্য মনোনীত হন জিন। এর ঠিক চার বছর পর তার নির্মিত সিনেমা ‘মানরো’ সেরা অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরষ্কার পায়। ১৯৬৪ সালে আবার সেই অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম  ক্যাটাগরিতেই ‘নাডনিক’ ও ‘হাউ টু অ্যাভয়েড ফ্রেন্ডশিপ’ ছবির জন্য অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি সিডনি এলিফ্যান্ট, গ্যাস্টন লে ক্রাইওন, ক্লিন্ট ক্লোবার এবং টেরেবল থম্পসনের মতো বিখ্যাত সব কার্টুন চরিত্রের নিমার্তা।

‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুন সিরিজের আট জন পরিচালকের মধ্যে একজন হচ্ছেন এই জিন ডেইচ। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের ১৩টি পর্ব তাঁর পরিচালনা করা। এই প্রজেক্টের সাথে তিনি ১৯৬১-৬২ সালে কাজ করেন।

তবে কার্টুন নির্মাণের শুরুর দিকে তাকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেকে এটাও বলেছেন যে, টম অ্যান্ড জেরি তার জীবনের সবচেয়ে বাজে সিরিজ হিসাবে প্রমাণিত হবে। কিন্তু তিনি তার কঠোর পরিশ্রম ও সৃজনশীল প্রতিভার সাহায্যে এ ধরনের সমালোচনাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘পাপাই দ্যা সেইলর’ কার্টুন সিরিজের কিছু পর্বও পরিচালনা করেছেন।

নর্থ এভিয়েশনে কাজ করার সময় মেরী নামের একটি মেয়ের সাথে তাঁর পরিচয় হয়, যা পরে প্রণয়ে পরিণত হয়। তারা দুজনেই একত্রে নর্থ আমেরিকার এভিয়েশনে কাজ করতেন। ১৯৪৩ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন সন্তান কিম ডিচ, সাইমন ডিচ এবং সেথ ডিচ। তিন সন্তানই বাবার পথের অনুসারী এবং অলটারনেটিভ কমিকস নিয়ে কাজ করেছেন।

১৯৫৯ সালে যখন জিন চেক প্রজাতন্ত্রে যান। সেখানে তাঁর দেখা হয় জেডেনকা নাজমেনোর সাথে। জেডেনকা ছিলেন সেখানকার প্রোডাকশন ম্যানেজার। পরবর্তীতে জেডেনকার জন্যই চেক প্রজাতন্ত্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন ডেইচ। ১৯৬৪ সালে জিন আবারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং মৃত্যুর আগে পর্য ৫৫ বছর তাঁরা সুখে শান্তিতে বসবাস করেন।

অ্যানিমেশন জগতে ২০০৩ সালে আসিফা হলিউড থেকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় এই কিংবদন্তিকে। ঠিক এক বছর পর আবার ২০০৪ সালে ভূষিত হন উইনসর ম্যাকে অ্যাওয়ার্ডে। নিজের আত্মজীবনী সম্পর্কে তিনি “ফর দ্যা লাভ অভ প্লেগ” বই লেখেন যা ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়।

২০২০ সালের ১৬ই এপ্রিল এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটে। ৯৫ বছর বয়সে নিজ বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান নির্মাতা। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের শৈশবের দিনগুলো আনন্দময় করার পেছনে এই উজ্জ্বল ধ্রুবতারার অবদান সবাই আজীবন স্মরণ করবে।

Sharing is caring!

Leave a Comment