‘কাননবালা’ পরিচয়ই যার যথেষ্ট!
- জশোয়া
ভারতীয় বাংলা সিনেমার গ্ল্যামার কুইন খ্যাত অভিনেত্রী কানন দেবী। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো- “কে বাবা, কে মা দিয়ে কী হবে! আমার কাননবালা পরিচয়ই যথেষ্ট।” তাঁর উক্তিটির সাথে দ্বন্দ্বে জড়াবেন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়৷কেননা তিনি নিজ যোগ্যতায় প্রমাণ করেছেন যে তাঁর কাননবালা পরিচয়ই যথেষ্ট। শূন্য থেকে নিজ যোগ্যতায় উঠে এসেছিলেন উচ্চতার শিখরে। গৃহকর্মী থেকে হয়েছিলেন ভারতীয় সিনেমার সুপারস্টার।
কানন দেবীকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার প্রথম নায়িকা এবং বাংলা সিনেমার প্রথম সুপারস্টার। তবে এই সুপারস্টার এর শুরুটা মোটেও সুখকর ছিলোনা। ছোটোবেলায় লোকের বাসায় বাসায় কাজ করতেন কানন দেবী। সেখান থেকে ধীরে ধীরে জায়গা করেছেন ভারতীয় সিনেমা জগতে, তাও আবার এতো পাকাপোক্ত ভাবে! লোকের ঘরে ঘরে কাজ করা সেই কাননবালা থেকে পর্দার সামনে কানন দেবী হয়ে ওঠা নেহাত মুখের কথা নয়। বিভিন্ন সিনেমায় তিনি বিভিন্ন গল্পে অভিনয় করলেও তাঁর জীবনের গল্পই যেনো হার মানাতে পারে গোটা একটি সিনেমার কাহিনীকে।
১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন কানন দেবী। যদিও তাঁর জন্ম পরিচয় নিয়েও রয়েছে নানান কথা। কারো কারো মতে কানন দেবীর জন্ম ১৯১৬ তে নয় ১৯১২ তে ৷তবে কাগজ-কলমের হিসেব ধরে যদি এগোই তবে তাঁর জন্ম ১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল। কিন্তু তার জন্মপরিচয় নিয়েও রয়েছে মহা বিপত্তি। তাঁর বিভিন্ন আত্মজিবনীমূলক লেখা থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন একজন রক্ষিতার সন্তান। তাঁর মায়ের নাম ছিলো রাজবালা দেবী ও বাবার নাম রতন চন্দ্র দাস৷ জানা যায় তাদের মধ্যে কোনো বৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক ছিলোনা।
তবে তাঁর বাবা-মাকে নিয়ে নানান গুঞ্জন থাকলেও কানন দেবী এ বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চাননি। কাননের নয় বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের বাড়িতে রাঁধুনী আর ঝিয়ের কাজ শুরু করেন কাননের মা। আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনার ইতি টানতে হয় কাননকে। বাবা এবং তাঁর স্বপ্ন ছিল গায়িকা হবার কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর নিয়তির যাতাকলে পরে তিনিও মায়ের মত শুরু করেন লোকের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ।
কাননদেবীর অভিনয় জগতে আসার কারণ চরম দারিদ্র্যতাই। যদিও ছোটোবেলা থেকেই কাননের নাচগানের প্রতি মারাত্মক ঝোঁক ছিলো৷ মাত্র ১০ বছর বয়সে অভিনয়জগতে নাম লেখান কানন দেবী। এরপর ধীরে ধীরে সিনেমা ও গানের জগতে আশ্চর্য মায়াজাল গড়ে তুললেন কানন দেবী আর নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়!
তবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের পরও তাঁকে পোহাতে হয় অনেক কাঠখড়। প্রায়শই নানান হয়রানির শিকার হতেন তিনি। এর সবথেকে বড় কারণ ছিলো, তিনি ছিলেন অভিভাবকহীন নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে। যার কারণে নগ্ন দৃশ্যে অভিনেয়ের জন্যে বাধ্য করা হতো তাকে। ১৯৩৫ সালে সতীশ দাশগুপ্তের বাসব দত্তা চলচ্চিত্রে তাঁর অনিচ্ছায় সত্ত্বেও নগ্ন দৃশ্য ধারণ করা হয়। একে তো অল্প বয়স তার উপর অসহায়। এই সুযোগে পরিচালকেরা অর্থিকভাবেও ঠকাতেন তাঁকে।
১৯২৬ সালে কানন দেবীর অভিনয়ের যাত্রা শুরু হলেও তাঁর সত্যিকারের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ এর মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে সাড়া ফেলেন। এরপর ১৯৩৭ সালে ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্র সেই প্রথম তাঁকে অভিনেত্রী হিসেবে সফলতা এনে দেয়। তাঁর অভিনীত বিভিন্ন সিনেমার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু সিনেমা হলো, ঋষির প্রেম, প্রহলাদ, কংসবধ, বিষবৃক্ষ, পরাজয়, মুক্তি, মেজদিদি ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ভালো গানও করতেন। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় কিছু গান হলো- আমি বনফুল গো, সে নিলো বিদায়, ফেলে যাবে চলে, জারা নেয়নো সে নেয়না, আব চান্দ না শরমায়ে ইত্যাদি।
একাধারে অভিনয়, নাচ, গান সমানতালে সব চালিয়ে গিয়েছেন কাননদেবী। নায়িকা, গায়িকা, প্রযোজক নামের পাশে আরো কত কি! এসব কারণেই মূলত তাঁকে বলা হতো ইন্ডাস্ট্রির জননী। কাজের জন্য স্বীকৃতিও নেহাত কম পান নি। ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পান। ১৯৯০ সালে তিনি সিনে সেন্ট্রাল কর্তৃক হীরালাল সেন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯১ সালে কানন দেবী ‘ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি পুরস্কার’ পান। এছাড়াও তাঁর ঝুলিতে আরো অনেক পুরষ্কার রয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
শেষ বয়সে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন সেবামূলক কাজে। দুস্থ বয়স্ক শিল্পীদের জন্য অনেক সাহায্য করে গেছেন৷ ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বেলভিউ ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেদিন তাঁর জীবন থেমে গেলেও প্রমাণ করে গেছিলেন, বারংবার হোঁচট খেয়েও বাস্তবজীবনে টিকে থাকার লড়াইয়ে জয় হয়েছিল তাঁরই।