দিনবদলের পথে দক্ষিণের কৃষি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
নদী-খাল-বিলে ঘেরা দক্ষিণাঞ্চল। আছে শস্য ভান্ডারের তকমা। শস্য ভান্ডারের এক ধান নিয়েই ছিল সব আরাধনা। কিন্তু একটি খামার বদলে দিচ্ছে দক্ষিনের কৃষির পুরনো সব গল্প। কৃষক এখন স্বপ্ন দেখছে সূর্যমুখির। সূর্যের মতই আলো ছড়াবে দক্ষিণের মাঠে মাঠে! যা থেকে উৎপাদন হবে তৈল। বালু চরের গাছে গাছে ঝুলবে থোকা থোকা ভূট্টা। যে মাটিতে পাট আবাদ ছিল দিবাস্বপ্ন! সেখানেই লকলকিয়ে বেড়ে ওঠবে সোনালী আঁশ। তিন বেলাই যাদের খাবারের থালায় উঠতো ভাত, সেখানে গমের কল্যানে থাকবে রুটি। গোলআলু হবে সহজলভ্য সবজি। এ ছাড়াও জলবায়ু পরির্বতণের কারণে লবনসহিষ্ণু ধান বীজও উৎপাদন করা হবে এ খামারে। আরো কত কত শস্যবীজ।
না, এসব কল্পনা নয়। বাস্তবেই হচ্ছে পটুয়াখালীর দশমিনার বীজ উৎপাদন খামারে। এখানে উৎপাদিত বীজ এ বছর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলায় কৃষকদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে এখানে উৎপাদিত বীজ আবাদে উদ্বুদ্ধ করা হবে কৃষককে। বদলে যাবে দনিাঞ্চলের কৃষি অর্থণীতির চিত্র। এখানেই থেমে থাকবে না খামারের বীজ। দক্ষিনাঞ্চলের বিখ্যাত সুগন্ধি কালিজিরা কিংবা বাঁশফুল বালাম বীজ পৌঁছে দেওয়া হবে সারা দেশের চাষির হাতে।
সম্ভাবনা যে পথে
দশমিনা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোনে বাঁশবাড়িয়া লঞ্চঘাট। ওই লঞ্চঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১৪ থেকে ১৬ মিনিট ব্যবধানে তেঁতুলিয়া নদী পার হয়ে বীজ উৎপাদন খামারটির অবস্থান। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বীজ উৎপাদন খামারটি তৈরীর উদ্যোগ নেয়। এ জন্য দশমিনার চর বাঁশবাড়িয়া ও চর বোতামে ১০৪৪ দশমিক ৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ১৯ মার্চ এ খামারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় বীজ উৎপাদন খামারের কার্যক্রম। এতে অর্থের যোগান দিচ্ছে যৌথভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গত আমন মৌসুমে খামারে প্রায় ১৫ জাতের ধান আবাদ করা হয়। উৎপাদন হয় প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন ধানবীজ। স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে সহনশীল ও বাম্পার ফলনের প্রত্যাশায় আফ্রিকান জাত নেরিকা ১, নেরিকা ১০ ও নিউট্যান্ট প্রজাতির ধান বীজের চাষ হচ্ছে। আরো রয়েছে বিলুপ্তির পথে হাঁটা স্থানীয় জাতের ধান সুগন্ধি কালিজিরা, বাঁশফুল বালাম, কাজল শাইল, কুটিঅগ্রানী, লাল মোটা, সাদা মোটা, লতর মোটা, মাটির চাক ও মোতা মোটা। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ধান গবেষনা থেকে উদ্ভাবিত ব্রি ধান-৫২, ব্রি ধান-৫৬, ব্রি ধান-২৩ ও বিনা শাইল জাতের বীজ উৎপাদন হচ্ছে।
প্রায় ৫০৬ একর জমিতে বোনা হয়েছে গোলআলু, গম, ভূট্টা, চিনা কাউন ও সরগম বীজের। তৈল বীজের মধ্যে রয়েছে সূর্যমুখি, তিল ও সরিষা। এ ছাড়া রয়েছে ডাল বীজ ফেলন, খেসারী, মুশরি ও মুগ। উৎপাদন করা হবে সোনালী আশ পাটের বীজও।
বীজ উৎপাদনে সার্বনিক কাজ করছেন আনুমানিক ৪০০জন। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তা রয়েছেন ২৫ জন। ওই দপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মী রয়েছে ৫৩জন। এদের নির্দেশনায় ২৫০ থেকে ৩০০ শ্রমিক ফসল উৎপাদনে কাজ করছেন।
এদিকে জলবায়ু পরির্বতণের ফলে দনিাঞ্চলের নদ-নদীসহ ভূ-গর্ভস্থ পানিতে লবনাক্ততার পরিমান আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তাই ধান চাষ যাতে বাধাাগ্রস্থ না হয় সে জন্য লবন সহিষ্ণু জাতের ধান চাষ ছড়িয়ে দিতে ব্রি ধান-৪৭, বিনা ধান-১০, বিনা ধান-৭ ও ব্রি ধান-৫৩ আবাদ হচ্ছে। এ সব জাত থেকে উৎপাদন হচ্ছে বিপুল পরিমান লবনসহিষ্ণু ধান বীজ। এছাড়াও দনিাঞ্চলের আবহাওয়ায় যেসব ফসল উৎপাদন কৃষকের জন্য লাভজনক হয় গবেষনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সেসব ফসলের বীজ উৎপাদন করা হবে জানান খামারের কর্মকর্তারা।
স্থানীয় চাষিদের কথা
বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কৃষক ইমাম হোসেন সরদার জানান, এই এলাকার কৃষকরা এক ফসলি আমন ধান ছাড়া অন্য ফসলে আগ্রহী নয়। তাছাড়া অন্য ফসলের বীজও পাওয়া যায় না। তাদের ধারণাও ছিল না এই জমিগুলো বহুফসলি। বীজ খামার হওয়ায় ফলে তাঁদের সে ধারণা পাল্টে গেছে। এখন আর জমি অলস পড়ে থাকবে না। একই গ্রামের কৃষক মো. তাজুল ইসলাম খাঁ জানান, আশপাশের এলাকার কৃষক যারা খামার দেখেছে তারা সবাই খুশি। মৌসুম অনুযায়ী হাতের নাগালে বীজ পেয়ে সব সময় ফসল ফলাবে কৃষক। ১২ মাস কৃষকের বাড়িতে নতুন নতুন ফসলের গন্ধ থাকবে।
গছানি গ্রামের কৃষক আফজাল মৃধা জানান, যেসব ফসল আগে হয়নি এই এলাকার জমিতে তা এখন থেকে হবে। এই বীজ খামার কৃষকের ভাগ্য বদলে অবদান রাখবে।
কর্মকর্তাদের কথা
দশমিনা বীজ উৎপাদন খামারের প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মিজানুর রহমান জানান, এখানে উৎপাদিত ধানের ফলন যেমন ভাল তেমন বীজের গুণগত মানও সন্তোষজনক। এখানে উৎপাদিত ধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, খরা-বন্যা ও লবণসহিষ্ণু।
বিএডিসির সদস্য পরিচালক মো. নুরুজ্জামান জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে এ খামার কাজ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলাম জানান, দশমিনার খামার থেকে এ অঞ্চলের কৃষকদের নতুন নতুন জাতের ধানবীজ ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া হবে।