পোনা উৎপাদন করে কোটিপতি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
পোনা বিক্রি করে একযুগেই কোটিপতি হয়েছেন ময়মনসিংহের রিলায়েন্স অ্যাকোয়া ফার্মসের মালিক রীতিশ পণ্ডিত। মনোসেক্স তেলাপিয়ার মানসম্মত রেণু-পোনার উৎপাদক হিসেবেও দেশে-বিদেশে রয়েছে তার সুনাম। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও। তার খামারের উৎপাদিত রেণু-পোনা চাষ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৎস্যচাষীরাও এখন স্বাবলম্বী। বর্তমানে ৪০ একর লিজকৃত জমির পৃথক দুটি খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে শতাধিক বেকার যুবকের। তার খামারে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আসেন পরিদর্শনে, প্রশিক্ষণ নিতে আসেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও।
সফল চাষী হিসেবেও ডাক পাঠান বিভিন্ন বিশ্বদ্যিালয়ের সেমিনারে। সরেজমিন দেখা গেছে, রীতিশ পণ্ডিত প্রখর রোদে শ্রমিকদের সঙ্গে পুকুরে কাজ করছেন। ঘনত্ব কমাতে এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার মা মাছ স্থানান্তর করছেন। তিনি যুগান্তরকে জানান, প্রায় এক লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০৪ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ত্রিশাল উপজেলার বৈলর উকিলবাড়ি নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত রিলায়েন্স অ্যাকোয়া ফার্মস। বর্তমানে ৬৫টি পুকুর থেকে প্রতি বছর পাঁচ কোটি মনোসেক্স তেলাপিয়া ও দুই কোটি দেশীয় প্রজাতির পাবদা-ঘোলসা ও শিং-মাগুরের পোনা উৎপাদন হয়। এতে সাত থেকে আট কোটি টাকা আয় হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক গোলাম হোসেন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএইচএম কোহিনুর এই চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। মাছ চাষে কাক্সিক্ষত সফলতা ও প্রযুক্তির পাশাপাশি আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়াতে তিনি স্থানীয় আল-ফালাহ নামে একটি খামারে চাকরিও করেছেন। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের দাওদপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক রণেন্দ্র চন্দ্র পণ্ডিতের ছেলে রীতিশ পণ্ডিত। ১৯৮১ সালে আনন্দমোহন সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে বাড়ির পাশে ৫০ শতক পৈতৃক জমির দুটি পুকুরে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় করে পরীক্ষামূলক মাছ চাষ শুরু করেন। স্থানীয় নদী ও যমুনা নদী থেকে কার্প জাতীয় মাছের রেণু সংগ্রহ করে তা পুকুরে চাষ করে বিক্রি করতেন। সে সময় প্রশিক্ষণ না থাকায় কোনোরকমে চালাতেন ব্যবসা।
৮৬ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার পর কার্পজাতীয় মাছের রেণু উৎপাদন শুরু হলে সেখান থেকে ৫ হাজার টাকায় এক কেজি রেণু কিনে বাড়ির চারটি পুকুরে চাষ শুরু করেন। এরপর সেই পোনা পাতিলওয়ালাদের কাছে বিক্রি করে এক লাখ টাকা লাভ করেন জেলার একমাত্র মাছ চাষী হিসেবে। সে সময় একই উপজেলার নলদিঘী গ্রামের আবদুল কুদ্দুস নামে একজন পোনার ব্যবসা করতেন। মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় পৈতৃক ৮ একর জমিতে মাছ চাষ শুরু করেন। শিক্ষিত এই যুবকের উৎসাহ আর লাভ দেখে আশপাশের গ্রামের অনেক বেকার যুবক উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন এ পেশায়। ৫-৭ বছরের ব্যবধানে চাষীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দেড় শতাধিকে। সেইসঙ্গে পোনার দামও কমতে থাকে।
এরপর ৯৫ সালে ছোট্ট পরিসরে বাড়ির পাশেই একটি হ্যাচারি গড়ে তোলেন। তাতে খরচ পুষিয়ে কোনোরকমে চলেন। ১৯৯৯ সালে কার্পজাতীয় মাছচাষে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর চাষে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় বড় পরিসরে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সে সময় প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকাসহ চাষ প্রযুক্তি রপ্ত করতে চাকরি নেন জেলার অন্যতম সর্ববৃহৎ ত্রিশালের বৈলর এলাকার আল-ফালাহ ফিসারিতে। যে প্রতিষ্ঠানটি দেশব্যাপী মাছ চাষের রুপালি বিপ্লবকে ছড়িয়েছে।
দীর্ঘ ৫ বছর ওই প্রতিষ্ঠানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অভিজ্ঞতা, গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বিএফআরআই, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন স্থানে। এরপর ২০০৪ সালে নিজের ১০ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর ডিপোজিট পেনশন স্কিম থেকে প্রাপ্ত ৮৯ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ৯৯ হাজার টাকা হাতে নিয়ে চাষী হিসেবে স্বপ্নের বাস্তবতায় পা বাড়ান।