সম্ভাবনাময় নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড পাল্টে দিয়েছে জেলার মানুষের জীবিকার চিত্র। এই রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অন্যান্য কারখানার পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আর মঙ্গাকবলিত এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতিকভাবে মুক্তির পথ প্রশস্ত করে দেয়ায় ভূমিকা রেখে এই ইপিজেড যেন পরিণত হয়েছে উত্তরবঙ্গের আশার আলোতে। নীলফামারী শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে সংগলশী ইউনিয়নে দেড় দশক আগে যখন উত্তরা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ চালু হয়, তখন এলাকাটি ছিল একটি নিভৃত মঙ্গাপীড়িত জনপদ। ২০০১ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশি ইউনিয়নে ২১৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইপিজেড উদ্বোধন করেন। ইপিজেডে বাণিজ্যিক ২০২টি প্লটের মধ্যে ১৩৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এখানে দেশী ও বিদেশী ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজ করছে অন্তত ২১ হাজার শ্রমিক।
উত্তরা ইপিজেডে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরি, ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেড, ম্যাজেন ইন্ডাস্ট্রিজ, ভেনচুরা লেদার ম্যানুফ্যাকচারিং, সেকশন সেভেন ইন্টারন্যাশনাল, কোয়েস্ট এ্যাক্সোসরিজ, কেপি ইন্টারন্যাশনাল, এসএ ইন্টারন্যাশনাল, ফারদিন এ্যাক্সোসরিজ, সনিক বাংলাদেশ, ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিজ, উত্তরা সোয়েটার ম্যানুফ্যাকচারিং বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ ছাড়াও হংকং, ব্রিটেন, চীনভিত্তিক বিনিয়োগকারী এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে পরচুলা, বাঁশ বেত, সানগ্লাস, লেদার ব্যাগ, ওয়ালেটলেট, প্যান্ট, শার্ট, হ্যাংগার, সোয়েটার ও খেলনা। মোট ২০২টি প্লটের এ ইপিজেডের একমাত্র প্রতিষ্ঠান উত্তরা সোয়েটার ফ্যাক্টরি দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত নিভু অবস্থায় অস্তিত্ব ধরে রেখেছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে এখানে সাতটি ফ্যাক্টরি উৎপাদন শুরু কাজ শুরু হয়েছে।
হংকংভিত্তিক এভারগ্রীন নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ শিল্পাঞ্চলে সাড়ে ৫ হাজার বর্গমিটার একটি ফ্যাক্টরি বিল্ডিং ভাড়া নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কৃত্রিম চুলা বানানোর কাজে সাফলতার প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ কোম্পানি এখানে ২শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ১০ হাজার স্থানীয় শ্রমিক কাজ পাবে। হংকংভিত্তিক আরও একটি জুতা কোম্পানি ‘পাদচেন’ এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। উত্তরা ইপিজেডে ওয়েসিস কফিনস নামে একটি প্রতিষ্ঠান কফিন তৈরি করছে। যা এই ইপিজেডের মধ্যে ব্যতিক্রম একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই উৎপাদিত কফিনগুলো যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে।
বলা যায় নীলফামারীতে উৎপাদিত কফিনের ওপর ইউরোপের বাজারগুলো নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে তৈরির পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কফিনগুলো প্যাকেটজাত হয়ে সরাসরি পাঠানো হয়। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) তথ্য অনুযায়ী, এ শিল্পাঞ্চলে বছরে ১ স্কয়ার মিটার ১ ডলার হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়, যা দেশের অন্যান্য ইপিজেডের অর্ধেক? এছাড়া এখানে চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর। এই ৩০ বছরের মধ্যে কোন ভাড়া বাড়ানো হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ইপিজেডটি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এ শিল্পাঞ্চলে প্রতি মাসে শ্রমিকরা প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা বেতন পায়। এসব কারখানা থেকে গত অর্থবছের ১৮ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে।
উত্তরা ইপিজেডে এখন কাজ করছেন ২২ হাজার শ্রমিক। তাঁদের ৬৫ শতাংশই নারী। পাশাপাশি এই ইপিজেডকে ঘিরে শহরের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি দেশী-বিদেশী কারখানা। সেগুলোয় আরও কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এসব কারখানা বদলে দিয়েছে এলাকাটিকে। আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় গ্রামের কৃষিশ্রমিকরা এখন কারখানা-শ্রমিক। নিস্তরঙ্গ গ্রামগুলোয় এখন ভিন্ন ধরনের কর্মব্যস্ততা। গৃহস্থ বাড়িগুলোয় এখন সচ্ছলতার ছাপ।
স্থানীয় লোকজন জানান, নীলফামারীর কৃষিশ্রমিকরা বছরের বেশির ভাগ সময় কাজের অভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করতেন। অনেকে কাজের সন্ধানে জেলার বাইরে যেতেন। এখন সে অবস্থা বদলে গেছে। এখন বরং আশপাশের কয়েকটি জেলার লোকজন এখানে এসে কারখানায় কাজ নিয়েছেন। এখানে বসতি গড়ে তুলছেন তাঁরা।
সম্প্রতি জেলা সদরের সংগলশী ইউনিয়নে উত্তরা ইপিজেড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা সকাল সাড়ে ৬টা থেকে দলে দলে প্রবেশ করছেন কারখানায়। মানুষের এ এক বিরাট স্রোত। কেউ সাইকেলে, কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ ইজিবাইকে আবার কেউ-বা হেঁটে। সময় মেপে কারখানায় ঢুকতে হবে। ব্যস্ত শ্রমিকদের পেছনে ফিরে তাকানোর সময় যেন নেই। সকাল ৭টার মধ্যে প্রায় সব কারখানার শ্রমিকরা ঢুকে যান নিজ নিজ কর্মস্থলে। দিনভর কাজ শেষে বিকেল চারটা থেকে একইভাবে বের হতে থাকেন বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সব শ্রমিক বের হয়ে যান। তখন ঘরে ফেরার প্রতিযোগিতা।
একসঙ্গে ২২ হাজার শ্রমিকের এই আসা-যাওয়ার কারণে সকালে আর বিকেলে দুই দফায় কারখানার সামনের রাস্তায় রীতিমতো যানজট লেগে যায়। শুধু কারখানার শ্রমিকদের আনা-নেয়াকে কেন্দ্র করে ইজিবাইকের রমরমা গড়ে উঠেছে। ভৌগোলিকভাবে নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেডের অবস্থান ভাল হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে গ্যাস সরবরাহ ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নীতকরণ করা হলে দেশের মধ্যে সেরা ইপিজেড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।