পাহাড়ী ভূমিতে চা ও রাবার চাষের সম্ভাবনা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
পাহাড়ী ভূমিতে রয়েছে চা ও রাবার চাষের অপার সম্ভাবনা।চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে প্রায় ১০ হাজার একর। বিশাল এ পাহাড়ী অঞ্চল বলতে গেলে পুরোটাই ন্যাড়া। সেখানে চা ও রাবার চাষ করে দেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখা সম্ভব। মাটি ও প্রাকৃতিক উপযোগিতা মীরসরাই উপজেলার এ বন ভূমিকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন শুধু চা বোর্ডের ঘোষণা এবং উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ।তবে আশার বিষয় হচ্ছে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় চা বোর্ডও বলছে- আগ্রহীরা উদ্যোগ নিলে বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা প্রদান করা হবে। চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাংলাদেশের রয়েছে সুখ্যাতি। তবে নানা কারণে সে ঐতিহ্য ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করেছে। দেশের অভ্যন্তরে চায়ের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে রপ্তানির মাত্রা কমিয়ে উল্টো আমদানি করতে হচ্ছে চা। আর চা বাগানের কথা উঠলেই এক সময় শুধু সিলেটের কথাই আসতো। কিন্তু এখন চা এর সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সম্পৃক্ততা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষ করে সিলেটের পর ফটিকছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান এলাকায় চা উৎপাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মীরসরাই উপজেলার পাশ্ববর্তী রামগড় ও ফটিকছড়িতেও চা এর চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি মীরসরাই উপজেলার পাহাড়ী অঞ্চলে চা চাষের অনুকূল উজ্জ্বল সম্ভাবনা সত্বেও এখানে শুধুমাত্র উদ্যোগের অভাবেই শুরু হচ্ছে না চা চাষ।অপরদিকে এই পাহাড়ী অঞ্চল রাবার চাষের জন্যও যথেষ্ট উপযোগী। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৩ সালে এই পাহাড়ী জোনে দাঁতমারা থেকে একটি রাবার বাগান উদ্যোক্তা পর্যবেক্ষক টিম এসেছিল। এখানে যথেষ্ট পরিমানে সম্ভাবনা দেখে বনশিল্প কর্পোরেশনে এর প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল। আবার বন বিভাগে জমি পাহাড়ী জোন বরাদ্দ পাবার প্রস্তাবনা দেয়া আছে। কিন্তু প্রক্রিয়া আর বেশিদূর এগোয়নি। এই বিষয়ে দাঁতমারা রাবার বাগান এর ডিজিএম তারেক মোঃ আজাদ জানান, বন বিভাগ আমাদের জন্য ভালো এলাকার কিছু সীমানা নির্ধারণ করে দিলে রাবার চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
রাবার ও চা চাষ একদিকে দেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক, অপরদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বিকল্পহীন শিল্প। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মীরসরাই উপজেলার পাশ্ববর্তী রামগড় চা বাগানটি স্থাপিত হয় ১৯১৫ সালে। পরবর্তীতে এর আশপাশেই পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠে দাঁতমারা, নেপচুন, আঁধারমানিকসহ অনেক চা বাগান। উক্ত চা বাগানসমূহ বিভিন্ন আয়তনের। রামগড় চা বাগান এর আয়তন ১৩৭৬ একর, দাঁতমারা চা বাগানের আয়তন ৬০০ একর, আঁধার মানিক চা বাগানের আয়তন ১৫০ একর। সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা এইসব চা বাগানের মালিক ।
চট্টগ্রাম চা বোর্ড এর নির্ধারিত নীতিমালার অধীনে সবাই এইসব চা বাগান পরিচালনা করছেন।বারইয়ারহাট-খাগড়াছড়ি সড়কের রামগড়ে অবস্থিত মনোরম চা বাগান এলাকায় এলে সৌন্দর্য্য পিপাসুরা ক্ষনিক দাঁড়িয়ে সারি সারি চা বাগানের মনোরম দৃশ্য অপলক তাকিয়ে একটু দেখে নেন। গন্তব্যের টানে আবার ছুটলেও কিছুনের জন্য মনোমুগ্ধকর সারি সারি সবুজের ঢেউ খেলানো এই স্থানটির প্রেমে পড়ে যান অনেকেই। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেল রুট থেকেই সারি সারি সুউচ্চ পাহাড় দেখে সকলেই মুগ্ধ হন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বনভূমি বিলীন হতে হতে এখন বর্ষা মওসুমে এখানে আংশিক সবুজ দেখা গেলেও শুস্ক মওসুমে ন্যাড়া পাহাড়গুলোকে ধূসর খাঁ খাঁ মনে হয়। যেন দিনে দিনে মরুভূমির রূপ লাভ করছে। কিন্তু চা বাগান গড়ে উঠলে এই জোনের বনভূমি যেন ফিরে পাবে নতুন প্রাণ। পাশাপাশি তা হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সবুজ এর অলংকরণ।
রামগড় চা বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার অতীশ সেন গুপ্ত বলেন, পেডরোলো এর মালিকানায় ১৩৭৬ একর বাগানে বছরে উৎপাদন হয় প্রায় ৬ লক্ষ কেজি চা। কয়েক শত শ্রমিক কাজ করে তাঁর বাগানে। তিনি বলেন চা বাগান সৃজনের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ধৈয্য ও একাগ্রতা। লাগার ৪-৬ বছর কোন আয়ের চিন্তা না করে শুধু বিনিয়োগ করে যেতে হয়। চারা থেকে গাছ চা ফলনে উপযোগি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাও এক প্রকার বিনিয়োগ।এদিকে একইভাবে মীরসরাই উপজেলার করেরহাট থেকে ওয়াহেদপুর পর্যন্ত ৩০ হাজার একর বনভূমির মধ্যে কিছু কিছু অংশ রিজার্ভ ফরেস্ট রেখে বাকি অংশকে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আয়তনের চা বাগান সৃজন প্রাকৃতিকভাবেই উপযোগী। মীরসরাই উপজেলা অঞ্চলের চা চাষের সম্ভাব্যতা বিষয়ে সিলেটের চা গবেষনা ইনস্টিটিউট এর মৃত্তিকা বিজ্ঞানী শেফালী ব্যানার্জির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মীরসরাই অঞ্চল চা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগি।
আর চট্টগ্রাম চা বোর্ডে এইসব অঞ্চলে চা চাষ বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাবনাও দেয়া আছে। মীরসরাইÑ সীতাকুন্ডের পাহাড়ী অঞ্চলগুলো অবাধে চা চাষের উপযোগি। এখানকার মাটি ও পরিবেশ অনুকূলে।বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের ১৬২টি বাগানের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ২০১৫ সালে ৬৭ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন প্রতি বছর আনুমানিক ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি হয়। কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কুয়েত, ওমান, সুদান, সুইজারল্যান্ডসহ অনেকগুলো দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের চা। গত দশ বছরে পৃথিবীতে চায়ের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর প্রায় ৫২ ভাগ চায়ের চাহিদা পূরণ করছে।
চা উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে না পারলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ অভ্যস্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশের চা বিদেশে রপ্তানি করা খুব কঠিন হবে। আবার আমাদের এই অঞ্চলের রাবার বাগানের রাবারও হতে পারে উৎকৃষ্টমানের। কারণ প্রাকৃতিকভাবে ছরা ও ঝর্ণাবেষ্টিত এই পাহাড়ী জোন অনেকভাবেই কৃষি বনায়নে সেরা উর্বর অঞ্চল। প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা যায়, প্রতিটি ক্ষুদ্রায়তনের ১ হাজার একর চা বাগানে বছরে আয় হতে পারে কোটি টাকা। আবার সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদের সম্ভাব্যতা ও সমীক্ষা অনুযায়ী নতুন জাতের বিটি-১৯ ও বিটি-২০ চা শিল্পের জন্য অবমুক্ত করা হতে পারে। এই চা চাষের উৎপাদন মীরসরাইয়ের পাহাড়ী অঞ্চলেও সম্ভব। এছাড়া চা শিল্পকে রক্ষা করার জন্য বিদেশ থেকে চায়ের আমদানি যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন চা চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। মীরসরাই উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর পাহাড়ী এলাকার মধ্যে করেরহাট, জোরারগঞ্জ, দুর্গাপুর, মীরসরাই, খৈয়াছরা, ওয়াহেদপুর এলাকার পাহাড়ে বিভিন্ন আয়তনের চা ও রাবার বাগানের উদ্যোগ গ্রহণ সবুজ আগামীর জন্যও সময়ের দাবি, যা থেকে উদ্যোক্তাগণ আয় করতে পারবেন কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি সরকারও অর্জন করবে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। সরকার অনেকভাবে চেষ্টা করেও এই এলাকায় বনাঞ্চল রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু চা ও রাবার চাষের উদ্যোগ নিলে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে সফলতা নিশ্চিত।