সোনালি আঁশে বাংলার হাসি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
একসময় পাট বাংলাদেশে প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কম থাকায় এবং দেশের অধিকাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাটের গুরুত্ব অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু গ্রাম-বাংলার পুরনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় এ মৌসুমে উৎকৃষ্ট মানের পাট চাষ হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার হাসাইল গ্রামে দেখা যায়, এ গ্রামে বসবাসরত অধিকাংশ নিতান্ত গরিব নারীরা সোনালি পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। গত কয়েক বছর প্রতিকূল আবহওয়ার কারণে এ অঞ্চলে পাট চাষে প্রায় বিমুখ হয়েছিলেন চাষীরা। এবার নতুন আশায় সোনালি আঁশখ্যাত পাট চাষে বাম্পার ফলন পেয়ে নারীরাও ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন বয়সের নারীরা পাটের বোঝা বেঁধে পানিতে জাগ দেয়া থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে সমান তালে জীবিকা নির্বাহ করছে। দেখা হয়, মধ্যবয়সী হালিমার সঙ্গে। কথা বলতেই জেনে নেই তার ছোট্ট জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প। অল্প বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামী ছিল পাশের গ্রামেরই এক কৃষকের ছেলে।
বাবার পেশাতেই ছিল স্বামী আলী আহম্মদ। অভাবের তাড়নায় সামান্য কৃষিজমি বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমায়। বর্তমানে হালিমার খোঁজখবর নেয় না তার স্বামী। হালিমার ৪ ছেলেমেয়েদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে এবং পড়াশোনার খরচ জোগাতে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজ নিয়েছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়িয়ে তিনি প্রতিদিন রোজগার করছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এ রোজগারের টাকা দিয়ে ৫ জনের সংসার ভালভাবেই চলে যায়। একটু এগিয়ে কথা হয় লিপি রানীর সঙ্গে। পাটের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি বললেন, মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে আমার। স্বামী সমির চন্দ্র একজন চাষী। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে নিজস্ব জমিতে কাজ শুরু করেন। বাড়িতে রান্না- বান্নার কাজ ও ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার পরেও স্বামীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত সে জমিতে কাজ করে আসছেন। জমিতে পাটের বীজ বোপন, পানি দেয়া, রোদে শুকানো ও পাটের আঁশ ছাড়ানোসহ সব কাজে অভিজ্ঞ নারী শ্রমিক তিনি। শুধু হাসাইল গ্রামের হালিমা ও লিপি রানীই নয় তাসলিমা, ফাতেমা বেগম, রুমা, রোজিনা, শেফালী, বৃষ্ণপ্রিয়া, রিনা, খালেদা বেগম, তামান্না, ফুলবানু, বিশখা, চন্দ্রসহ আটিগাঁও, ডাইনগাঁও মান্দ্রা, বয়ড়াতলা গ্রামের প্রায় কয়েকশত পরিবারের নারীরা পাটের আঁশ ছাড়িয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে সংসার চালাচ্ছেন।
এই গ্রামগুলো একসময় পদ্মার করাল গ্রাসে তাদের ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে সেখানে নতুন করে জেগে ওঠা চরে তারা কোনরকমে বসতবাড়ি তৈরি করে জীবনযাপন করছেন। পদ্মায় জেগে ওঠা সেই চরেই নতুন করে পাট চাষ করে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাট কেটে ১০ থেকে ১৫ দিন পানির নিচে ডুবিয়ে রেখে নিখুঁত হাতে নারীরা পচা পাট থেকে আঁশ ও পাটকাঠি আলাদা করে। পাট গাছের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই আঁশই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। মহাজনেরা প্রতিমণ পাট এক হাজার ২০০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু পাট চাষে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা বিরাট অবদান রাখলেও অধিকাংশ নারী শ্রমিকরা ন্যায্যমূল্য পায় না। নারীরা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি পাচ্ছেন তাদের চেয়ে কম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়িয়ে একজন পুরুষ মজুরি পায় ৩৮০ থেকে ৪১০ টাকা আর নারী শ্রমিক প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তারপরও তারা থেমে নেই। নারীরা পরিবার ও সমাজের উন্নয়নের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে তারা ভাগ্য উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছেন।