কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠা এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
কৃষকের ছেলে কৃষক হবে এমন কথা হাল আমলে একেবারেই ভিত্তিহীন। কিন্তু কৃষির ওপর ভিত্তি করে আজও আমরা আমাদের সুখ-দুঃখের হিসাব-নিকাশ করে থাকি। দেশের কৃষির উৎপাদন কমে গেলে সারাদেশের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। সমস্যাটি যেন শুধু কৃষকদের থাকে না, সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে। কৃষি দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৫৫ ভাগ কোন না কোনভাবে কৃষিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক এবং একটি সম্ভাবনাময় বৃহৎ বাজার। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের প্রবেশের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিতে শস্য, প্রাণিসম্পদ (গবাদিপশু, মৎস্য ও পোল্ট্রি) এবং বন খাত অন্তর্ভুক্ত। আমাদের জিডিপিতে কৃষির বর্তমান অবদান শতকরা ১৬ ভাগ। কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উপখাত হলো শস্য খাত যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৯.৫৬ ভাগ যোগান দেয়। মৎস্য, পশুসম্পদ এবং বন উপ-খাতের অংশ যথাক্রমে শতকরা ১০.৩৩, ১০.১১ এবং ১০.০০ ভাগ।
বর্তমানে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মধ্যে পোল্ট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, মৎস্য উৎপাদন, হিমায়িতকরণ শিল্প রয়েছে। এসব শিল্পে বেশকিছু বড় বড় কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। দেশের অনেক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানি যেমনÑ প্রাণ, স্কয়ার, এসিআই কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করছে এবং দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মাফিক বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত করছে। অনেক কোম্পানি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি কৃষিপণ্য সংগ্রহ করছে। তবে এখন পর্যন্ত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মূল কাঁচামাল কৃষি ফসল উৎপাদনে সরাসরি কোন বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। ব্যক্তি ও পারিবারিক উদ্যোগে কিছু কিছু ফলমূল ও সবজি উৎপাদন এলাকা গড়ে উঠলেও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠেনি কোন সুপরিকল্পিত কৃষি ফসল উৎপাদনমুখী ফার্ম। ফলে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কৃষক এবং বর্গাচাষীরাই ভরসা যাদের উৎপাদনের হার কম।
কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যে এলাকার জন্য যে ফসল উপযোগী সেসব এলাকায় বড় বড় ফার্মের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কৃষি ফসল উৎপাদন করা হয়। ইউএসডি পরিচালিত এক জরিপ মোতাবেক, আমেরিকার মোট কৃষি ফার্মের সংখ্যা ২১,০৯,৩৬৩টি যাদের প্রতিটির গড় জমির পরিমাণ ৪৩৪ একর। মোট ফার্ম সংখ্যার মধ্যে যেমন ১০০০ একর বা তার অধিক আকারের বৃহৎ ফার্ম রয়েছে, তেমনি ১-৯ একর জমির ক্ষুদ্র ফার্মের পাশাপাশি ১০-১০০০ একর জমির মাঝারি আকারের ফার্মও রয়েছে।
দেশে কৃষি উৎপাদন ফার্ম গড়ে উঠলে পরিকল্পিতভাবে মাটির গুণাগুণ অনুসারে খ–খ- জমিগুলো এক করে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে এবং উৎপাদন আরও বৃদ্ধি হবে। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণও অনেকাংশে সহজ হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি লিজ নিয়ে যেমন বড় বড় মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে তেমনই অন্যান্য এলাকায়ও এরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করে কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
অধুনা আমাদের পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তানেও অনেক কৃষি ফার্ম গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশের জমির মালিকপক্ষ, ফার্ম পরিচালনাকারী কোম্পানি বা এনজিও, প্রশাসন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমন্বয় করে কৃষি ফার্ম গঠন কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটা অবশ্যই সম্ভব। এরূপ কয়েকটি ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে লাভের মুখ দেখলে বড় এবং মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠান কৃষি ফার্মভিত্তিক বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। আর এভাবেই কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিনির্ভর চাষাবাদের প্রক্রিয়া সারাদেশে সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির গতি সঞ্চারপূর্বক কৃষি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে।