সবুজ অর্থনীতি এবং বর্তমান বাংলাদেশ
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নই সবুজ অর্থনীতি। সহজভাবে বলতে গেলে, সবুজ অর্থনীতি হলো সেই অর্থনীতি যা মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে কিন্তু একই সঙ্গে পরিবেশগত ঝুঁকি কমাবে এবং অভাব দূর করবে। অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায়শই বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে। অধিকন্তু ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে ভিন্নতা দেখা দিচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে টার্ন ডাউন দ্য হিট: ক্লাইমেট রিজিওনাল ইমপ্যাক্ট এন্ড কেস ফর রিজিলিয়ান্স শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখ করেছে-
ক) ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বাংলাদেশের ৩৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যায়। ওই ঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ২০৫০ সালের মধ্যে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে তিন মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূলে আঘাত হানবে। এতে ৯০ লাখ মানুষের বাড়িঘর ডুবে যেতে পারে।
খ) ২০৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৫ সেন্টিমিটার বাড়লে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের ৪০ শতাংশ ফসলি জমি হারিয়ে যাবে।
ভূমির ক্ষয়রোধ, নদীভাঙ্গন, জমির উর্বরতা রক্ষায় আমাদের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের জমি, বসতভিটা। কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবস্থান যেন আরও খারাপ। কৃষি, কেমিক্যাল ও ট্যানারি শিল্পে কোন রকম সতর্কতা অবলম্বন না করেই শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে কাজ করছে। কলকারখানার এসব বিষাক্ত বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমিতেও সেই পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করেছে এই বর্জ্য পদার্থ। ফলে নদী তার নাব্য হারাচ্ছে। নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। অসংখ্য পুরনো এবং অযোগ্য যানবাহন চলাচল করার কারণে ব্যাপক দূষণ ঘটছে। জ্বালানি তেল ব্যবহারের ফলে যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগবালাই সৃষ্টি করে চলেছে।
আমাদের কৃষকরা কৃষিকাজে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সারও কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। এতে করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সরকার সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যা খুবই ইতিবাচক। ইটভাটি থেকে বায়ু দূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে পুরনো ইটভাটিগুলোকে পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটি অর্থ এমন ইটভাটি যা জ্বালানি সাশ্রয়ী, উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন, যেমনÑ হাইব্রিড হফম্যান কিলন, জিগজ্যাগ কিলন, ভারটিক্যাল স্যাফট ব্রিক কিলন, টানেল কিলন, বা অনুরূপ কোন ভাটা। ব্যাংকগুলো পুরনো ইটভাটি তৈরির জন্য এখন ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি আইন অনুমোদন করা হয়েছে। সৌরবিদ্যুত ও বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের দ্রুত সম্প্রসারণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সকল জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপন করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাণিজ্যিক উৎপাদনের উপর প্রথম পাঁচ বছর আয়কর মওকুফ করা হয়েছে।
জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহী করতে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্জ্য থেকে জৈবসার তৈরির প্রকল্প চালু করে ইতোমধ্যেই আমরা কার্বন ক্রেডিট লাভ করেছি। পপুলারস পে-প্রিন্সিপালের আওতায় পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্তানুসারে দূষণ নিয়ন্ত্রণে এনফোর্সমেন্ট ও মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় গত ১৮-০৪-২০১৫ তারিখে পরিবেশ অধিদফতরের এনফোর্সমেন্ট উইং কর্তৃক দূষণবিরোধী অভিযানে গাজীপুরের ২টি ডাইং কারখানা পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতি সাধনের জন্য ৫৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বন অধিদফতরের তথ্য মতে, সামাজিক বনায়নের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৪৪,৪০৮ হেক্টর উডলট বাগান, ১০,৬২৬ হেক্টর কৃষি বন বাগান, ৬১,৭৩৯ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান সৃজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিগত ৪ বছরে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড আওতাভুক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী, স্বল্পমেয়াদী ও নন-ম্যানগ্রোভ ২৯৫৫ হেক্টর ব্লক বনায়ন এবং সড়ক রেলপথ ও বাঁধ সংযোগ সড়কে ২৬৪১ কি. মি. স্ট্রিপ বনায়ন করা হয়েছে। সৃজিত বাগানে প্রায় ৫ লাখ উপকারভোগী সম্পৃক্ত আছে।
সারাদেশে ব্যাপক বনায়নের লক্ষ্যে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৬৩ হাজার চারা বিক্রয় ও বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ বনায়নের আওতায় ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩১ হাজার ১৫০ ঘনফুট কাঠ, ১ কোটি ৭৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫২১ ঘনফুট জ্বালানি কাঠ ও ৪৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৮৬টি বল্লী উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত কাঠ, জ্বালানি কাঠ ও বল্লী বিক্রয় করে ৪৫৯ কোটি ৯৯ লাখ ৪৮ হাজার ২৩২ টাকা পাওয়া গেছে। ১ লাখ ৫ হাজার ৬৩৩ জন উপকারভোগী প্রাপ্ত লভ্যাংশের পরিমাণ ২০৮ কোটি ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩৩ টাকা। টিএফ হিসেবে প্রায় ৪৫ কোটি ১৯ লাখ ৪ হাজার ৬৫৬ টাকা জমা হয়েছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সরকারী রাজস্ব হয়েছে ২০৫ কোটি ৩৭ লাখ ৮৪ হাজার ৮৭০ টাকা।
শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি দেশের টেকসই উন্নয়ন নয়। প্রকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ এর সঙ্গে জড়িত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ উভয়ই একটি দেশের জন্য অপরিহার্য। প্রাণের প্রিয় বাংলাদেশ নামের এই ছোট দেশে আমাদের বসবাস উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে সবুজ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া উপায় নেই। যেহেতু আমরা জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম দেশগুলোর একটি, তাই আমাদের দেশে সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নে যেসব সমস্যা রয়েছে তার সমাধান অতীব জরুরী।