নকশিকাঁথায় স্বাবলম্বী
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
ওরা সুঁই-সুতার কারিগর। নকশিকাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে ওরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। মেহেরপুরের তৃপ্তিকণা বিশ্বাস নকশিকাঁথা তৈরি করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন, গ্রামের অসহায় বিভিন্ন বয়সী নারীদেরও নকশিকাঁথা তৈরি শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলছেন।
মেহেরপুরের ভবেরপাড়া, সহগলপুর, কুলবাড়িয়া গ্রামের বউ-ঝিদের তৈরি নকশিকাঁথা মেহেরপুরের এই গ্রামগুলো ছাড়িয়ে দেশ-দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই গ্রামগুলো নকশিকাঁথার গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে।
তৃপ্তিকণা বিশ্বাসের কাছে নকশিকাঁথার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে মালা খাতুন, সান্ত্বনা, পারুল, তসলিমা, হাসিনা, ময়না, ফিরোজা, রিতা, খুরশীদা, নিলুফা, জেসমিন, আসমা, আনজিরা, আলতাফুননেছাসহ প্রায় একশ’ নারী এখন স্বাবলম্বী। তারা নকশিকাঁথা সেলাই করে রোজগার করছেন। সহগলপুর গ্রামের আসমার মতে, দু’পয়সা বাড়তি আয়ের জন্য কত পথ খুঁজেছি। শেষে তৃপ্তিকণা আপার কাছে এই নকশিকাঁথা তৈরি শিখে এখন সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।
একই গ্রামের আলতাফুননেছা জানান, যৌতুকের কারণে দিনের পর দিন স্বামীর অত্যাচার সহ্য করেছেন। অত্যাচারের মাত্রা এত বেড়ে যায় শেষমেষ আর সহ্য করতে না পেরে একদিন প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদের জেরে স্বামী তাকে তালাক দেয়। ফিরে আসেন শ্রমজীবী বাবার ঘরে। স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে এই খবর শোনামাত্র তার বাবা স্ট্রোক করে মারা যান। ঘরে বৃদ্ধা মা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। বাধ্য হয়ে বাবার মতো মাঠে-ঘাটে শ্রমবিক্রি করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে সিডিপি কর্মী একই গ্রামের শেফালী আপার মাধ্যমে নকশিকাঁথা ও সেলাই মেশিনে দর্জির কাজ শেখেন। সে একযুগ আগের কথা। এভাবেই তিনি নকশিকাঁথা সেলাই করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই আয় থেকে কয়েকটি ছাগল কেনেন। গত কোরবানির ঈদে ২০ হাজার টাকার ছাগল বিক্রি করেন। বাড়িতে এখন তিনটি বড় ছাগল ও একটি গাভী আছে। দুটি সেলাই মেশিন কিনেছেন। যার একটি ভাড়া দিয়েছেন।
এভাবেই নিজের ভাগ্য নিজেই পরিবর্তন করেন আলতাফুননেছা। তার কাছে এলাকার অসহায় অনেক নারী কাজ শেখেন। তিনিও তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজের গ্রামের নারীদের পাশাপাশি পাশের গ্রামের নারীদেরও তিনি নকশিকাঁথা তৈরি শেখান। নকশিকাঁথার আয়ের টাকায় বাড়ি পাকা করেছেন, কিনেছেন আবাদি জমি, বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। একদিন সমাজে মাথা নিচু করে থাকতে হতো, দিন কাটতো অনাহারে। এখন সবাই তাকে ডেকে কথা বলে, সমাদর করে, প্রশংসা করে।
একই গ্রামের তসলিমা খাতুন ছেলেমেয়ের লেখা-পড়ার খরচ জোগাতে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ করেন। তসলিমা মেয়ে রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে দিন কুড়ির মধ্যে একটি কাঁথা তৈরি করতে পারেন। এই আয় থেকে তিনি একটি গাভী কিনেছেন। আর স্বামীর আয়ের টাকায় সংসার চালান। নকশিকাঁথার টাকা তাদের উন্নয়নের চাবিকাঠি।
সহগলপুর গ্রামের রিতার বাড়ির উঠোনে ২৫ থেকে ৩০ জন নারী নিপুণ হাতে কাঁথায় ফুল, কলস, পাখি, নৌকা, হাতি, ঘোড়া, বর, বধূ, পালকিসহ বাংলার লোক ঐতিহ্যের চিত্র সুঁই-সুতার ফোঁড়ে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে ফুটিয়ে তুলছেন।
নকশিকাঁথার কারিগর খুরশিদা ও নিলুফা একই স্বরে বললেন, এখন আমরা মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে আছি। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাঁথা, জায়নামাজ, বিছানা ও গায়ের চাদর, তোয়ালে, বালিশের কভারে বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের ওপর সুঁই-সুতার ফোঁড়ে নকশা তুলি। আমাদের সন্তানেরাও স্কুল-কলেজে যায়। সংসারেও এখন আমাদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া হয়।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পিস (সিডিপি) মেহেরপুর সংস্থার পরিচালক তৃপ্তিকণা বিশ্বাসের মতে, নকশিকাঁথার বৈচিত্র্যময় নকশার মতো এই জেলার অসহায়, তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা নারীদের জীবন বদলে গেছে। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নকশিকাঁথা সেলাই করে মাসে তারা প্রায় দুই হাজার টাকা আয় করেন। এই বাড়তি আয়ের টাকা দিয়ে সংসারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে ছেলেময়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগান। তাদের তৈরি এই নকশিকাঁথা আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, সুইজারল্যান্ডে বাজার সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান রানা বলেন, এ গ্রামের নারীরা এখন মিলেমিশে নকশিকাঁথার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন।