বরেন্দ্রজুড়ে মাল্টার আবাদ
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
এবার আমসাম্রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে হানা দিয়েছে ‘মাল্টা’। জেলার তিনটি উপজেলাসহ লাগোয়া রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলাজুড়ে মাল্টার আবাদে বড় ধরনের ঝড় তুলেছে। অঞ্চলটি বরেন্দ্র অঞ্চলের অংশবিশেষ। বৃহত্তর রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ২৪০-২৩/ হতে ২৫০-১৫/ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮০-০২/ হতে ৮৮০-৫৭/ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। বরেন্দ্রজুড়ে রুক্ষ আবহাওয়ার কারণে মধ্য জুন থেকে অক্টোবরের প্রারম্ভ পর্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে। নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোন বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। পুরো বরেন্দ্রের লালমাটিতে টক্সিনের পরিমাণ খুবই বেশি। আবার খালি চোখে দেখলে পাহাড়ী অঞ্চলের মতো ছোট ছোট টিলার আকার নজরে আসবে। এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। বহু স্থানে দেখা যাবে উচ্চ পাহাড়ের মতো স্থান। যা আগাছা জঙ্গলে ভরা। বরেন্দ্রর উন্নয়নে গঠিত বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প চাষীদের ভাগ্য উন্নয়নে নতুন ঠিকানা এনে দিয়েছে। একাধিক জাতের ধানের আবাদ, চৈতালী ফসলের রমরমা চাষাবাদ, পাশাপাশি টমেটোর আবাদে দেশ সেরা হবার সুবাদে কৃষিতে মহাবিপ্লবের সূচনা করেছে। প্রায় এক যুগের অধিককাল ধরে টমেটোর আবাদের কারণে অর্থনীতিতে যে গতির সঞ্চার হয়েছে তা যে কোন অঞ্চলের জন্য ঈর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যেই এসে পড়েছে মাল্টার আবাদ। বরেন্দ্রর লাল রুক্ষ মাটি ও আবহাওয়া যে মালটা চাষের জন্য খুবই উপযোগী এটা কারও ধারণা ছিল না। কিন্তু চাঁপাইনবাবগগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক ড. সাইফুর রহমান বারির একাধিক জাতের মাল্টা চারা এনে ধরিয়ে দেন বরেন্দ্রর কৃষকের হাতে। বছর দুয়েকের মধ্যে এক অভাবনীয় সাফল্য এনে দেয় মাল্টা চাষে।
মূলত এখানে ভারতীয় মাল্টা বাজার দখল করে রেখেছে দীর্ঘদিন। সেই ভারতীয় মাল্টার পাশাপাশি বরেন্দ্রর মাল্টা স্বাদে, গন্ধে ও মিষ্টতায় পৃথিবীর যে কোন স্থানের মাল্টাকে ছাড়িয়ে ঝড় তুলেছে দেশজুড়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের খুবই কাছাকাছি নয়াগোলা-আমনুরা সড়কের পাশে জামতলায় মতিউর রহমান নামের এক যুবক মাত্র দুই একরের কিছু বেশি অনাবাদি উঁচু টিলাজমি লিজ নিয়ে শুরু করেছিল মাল্টার আবাদ। সাফল্য এসেছে মতিউরের হাত ধরে। উৎপাদন খরচ খুবই কম হবার কারণে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে চাষের সম্ভাবনা। এ ছাড়াও ফলটির স্বাদ ও ঘ্রাণ অতুলনীয় হবার কারণে মতিউর এখন অনুকরণীয় হয়ে পড়েছে অনেকের কাছে। ছোট ছোট গাছে ঝুলছে থোকা থোকা মাল্টা। বাগানজুড়ে শোভা পাচ্ছে এক অভাবনীয় দৃশ্য।
চাঁপাই হর্টিকালচার প্রধান কৃষি গবেষক ড. সাইফুর রহমান জানান, এখানকার উৎপাদিত মাল্টার স্বাদ ও পুষ্টিগুণ আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে অনেক বেশি। মাত্র আড়াই বছরের চেষ্টায় বারি-১ জাতের মাল্টার আবাদে মতিউরের বাগান ভরে উঠেছে। এখানকার উৎপাদিত মাল্টা অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। নষ্ট হয় না আবার স্বাদও ঠিক থাকে। পাশাপাশি বেড়ে যায় মিষ্টির পরিমাণ। ১৬০ টাকা হালি দরে গ্রাকদের লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারিতে পৌঁছে দেয়া হয়। গতবছর এসেছিল প্রায় ৩০ হাজারের কাছাকাছি। এবার পেরিয়ে গেছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখনও বাগানভর্তি হয়ে মাল্টা রয়েছে। মৌসুম শেষ হলে হয়তবা এই অঙ্ক ১০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মতিউরের এই অভাবনীয় সাফল্য অনুসরণ করে ফিনল্যান্ড প্রবাসী সাবেক গোমস্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান বাচ্চু মিঞা নাচোলের নেজামপুরে প্রায় ৭ একর জমিতে এবার মাল্টার আবাদ শুরু করেছে। একইভাবে ঝিলিমের মাসুদ দুই একর, মাঝপাড়ার সামিম পৌনে দুই একর, ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব দেড় একরসহ একাধিক ব্যক্তি বরেন্দ্র অঞ্চলে মাল্টা আবাদ শুরু করেছে। গোদাগাড়ী উপজেলা সদরসহ কাঁকনহাট এলাকার গাছে মাল্টা ধরা শুরু হয়েছে। অনেক আগেই জামতলা এলাকার মতিউর এবার এখন পর্যন্ত ১২ লাখ টাকার শুধুমাত্র মাল্টার চারা বিক্রি করেছে। তার হাতে এখন ১০ হাজার মাল্টা চারা রয়েছে। ইতোমধ্যেই গাজীপুর থেকে আসা এক ব্যবসায়ী দেড় হাজার ও চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ী এক হাজার মাল্টা চারা নিয়ে গেছে। এ ছাড়াও কল্যাণপুর হর্টিকালচারের সহকারী হর্টিকালচারিস্ট জোহরুল হক ব্যক্তিগতভাবে বারো শ’ মাল্টা চারা কিনে কোথায় যেন পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে জেলার সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর ও পার্শ¦বর্তী উপজেলা তানোর ও গোদাগাড়ী বরেন্দ্র অঞ্চলে সম্প্রসাররিত হয়েছে মাল্টার আবাদ।
অনুমান করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বৃহত্তর রাজশাহীর পুরো বরেন্দ্রর অনাবাদী টিলাজমিতে মাল্টার আবাদ জোরদার হবে। বর্তমানে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে টমেটোর আবাদ প্রথম স্থানে থাকলেও যে হারে মাল্টার আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে তাতে ছাড়িয়ে যাবে টমেটোকে। কারণ প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে এবার পুরো বরেন্দ্রতে মাল্টা কেনা-বেচার পরিমাণ এক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে; যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাবে।