ছিলেন গৃহবধূ, এখন সফল উদ্যোক্তা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
সামনে বিশাল জমিতে সবুজ ঘাস। পূর্ব পাশে পুকুর। এর মধ্যে মাছের লুকোচুরি খেলা আর এক ঝাঁক হাঁসের ছুটোছুটি। পুকুরের চার পাশে সারি সারি লাউয়ের মাচায় ঝুলছে সবুজ লাউ। আছে পেঁপে আর কলাগাছও। তার এক পাশে গড়ে তোলা হয়েছে সেমি পাকা খামার শেড। খামারে রয়েছে উন্নত জাতের গবাদিপশু (গাভি ও ষাঁড়)। এতেই শেষ নয়, খামারের উত্তর পাশে জমা হচ্ছে গবাদিপশুর বর্জ্য। সেখান থেকে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস।
এক হাতে এত সব কাজ সামলাচ্ছেন একজন নারী। তাঁর নাম চেমন আরা বেগম। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী পৌরসভার চরখিদিরপুরে প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে এই সমন্বিত খামার। নাম ‘সি কে ডেইরি ফার্ম’। এ খামার থেকে চেমন আরার বছরে আয় এখন গড়ে ছয় লাখ টাকা। ৩৬ বছর বয়সী এই গৃহবধূ কীভাবে হলেন সফল উদ্যোক্তা?
১৯৯৮ সালে চরখিদিরপুর গ্রামের আবু মুছার মেজ মেয়ে চেমন আরার বিয়ে হয় একই গ্রামের প্রবাসী খোরশেদ আলমের সঙ্গে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। ১৯৯৭ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি। বর্তমানে চেমন আরা-খোরশেদের সংসারে রয়েছে তিন সন্তান—তানজিনা আকতার, মিজানুর রহমান ও মিনহাজুর রহমান। এর মধ্যে বড় মেয়ে তানজিনা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, মিজান দশম ও মিনহাজ পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। এ ছাড়া শাশুড়ি, দেবর-ভাশুর ও জা নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। সংসারের সব সামলেও নিজে কিছু করার ইচ্ছা ছিল চেমন আরার। তাঁকে সহযোগিতার হাত বাড়ান স্বামী।
২০১৪ সালের প্রথম দিকে উন্নত জাতের একটি অস্ট্রেলিয়ান গাভি ও একটি বাছুর কেনেন এক লাখ ৩২ হাজার টাকায়। দেখলেন দুধ উৎপাদন হচ্ছে দুই বেলায় ১৪ লিটার। বিক্রিও হচ্ছে ভালো। মাস তিনেকের মাথায় নতুন করে আরও পুঁজি খাটান। আরও বছরখানেক পর শুরু করেন মাছ ও সবজি চাষ। তিন বছরের মাথায় খামারের চিত্র পাল্টে যায়। বর্তমানে চেমন আরার খামারে গবাদিপশু রয়েছে ২০টি। তার মধ্যে গাভি ১০টি, বাছুর ৭টি ও ষাঁড় ৩টি। এসব গবাদিপশুর দেখভালের জন্য রয়েছেন চারজন শ্রমিক। প্রতিদিন তাঁর খামারে ১২০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি দুধ পাইকারি বিক্রি হয় ৫০ ও খুচরা ৬৫ টাকায়।
এ ছাড়া খামারে রয়েছে প্রায় চার হাজার বর্গফুটের পুকুর। এতে চাষ হয় শিং. মাগুর ও কই মাছ। এর থেকে বছরে আয় হয় এক লাখ টাকা। পুকুরপাড়ে লাউ, পেঁপে, কচু ও নানা ধরনের শাক। এসব বিক্রি থেকে আয় মাসে ১০ হাজার টাকা। জৈব সার হিসেবে বিক্রি হয় গরুর গোবরও। সব মিলিয়ে খরচ বাদ দিয়ে চেমন আরার মাসিক আয় এখন সোয়া দুই লাখ টাকার মতো। খরচ বাদ দিয়ে নিজের কাছে থাকে গড়ে ৫০ হাজার টাকা। গাভি বাছুর জন্ম দিলে তখন আয় বাড়ে। বাছুরও বিক্রি করেন তিনি। চেমন আরা পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন। আয়করও দেন নিয়মিত।
দেখা যায়, খামারে রয়েছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ঘাস কাটারসহ নানা আধুনিক মেশিন। রয়েছে পানিনিষ্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। গবাদিপশুর খাদ্যের জন্য নিজের জমিতে চাষ করছেন উন্নত জাতের পুষ্টিকর সবুজ বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস।
চেমন আরা বলেন, পশু খাদ্যের দাম বাড়তি হওয়ায় ও দুধের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় লাভ প্রত্যাশার চেয়ে কম হচ্ছে। বর্তমানে খামারের গাভি থেকে ১২০ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। সামনে আরও গাভি বাচ্চা দিলে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়া সরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়া যায় কম। চিকিৎসক ও ওষুধসংকটের কারণে গবাদিপশুর রোগব্যাধিতে বাড়তি ব্যয় হয়।
এদিকে খামারের গবাদিপশুর বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বায়োগ্যাস চেমন আরার পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতি চুলা ৬০০ টাকা করে এ গ্যাস ব্যবহার করছেন তাঁর চার প্রতিবেশী।
গ্যাস সরবরাহব্যবস্থা কতটুকু নিরাপদ জানতে চাইলে চেমন আরা বলেন, দেড় লাখ টাকা খরচ করে প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীর মাধ্যমে গ্যাসের লাইন করা হয়েছে। এটি নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। চেমন আরার খামারে বায়োগ্যাসের সরবরাহ লাইন করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তিশা এনার্জি লিমিটেডের বায়োগ্যাস প্রযুক্তি প্রকৌশলী আমিনুল হক। যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে বলেন, এটি শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত। এ ছাড়া বায়োগ্যাস পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানিসাশ্রয়ী।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব খান বলেন, স্বামী-সংসার সামলে একজন গৃহিণীর এ সাহসী উদ্যোগ প্রশংসার। চেমন আরা একজন সাহসী ও সফল খামারি। তাঁর খামারে ঘাস কাটার যন্ত্র থেকে শুরু করে গবাদিপশু রাখার ঘর—সবকিছুই আধুনিক মানের। তিনি আরও ভালো করবেন এবং তাঁর সফলতা দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধ হবে। তিনি জানান, চেমন আরাকে সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাঁরা।