বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন বাংলাদেশিরা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এ ক্ষেত্রে নীতিমালা ঠিক করা নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বর্তমানে বাংলাদেশি কোম্পানির বিদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক রক্ষণশীল। আর এ বিষয়ে সরকারকে উদার করার পক্ষে বড় ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত ১৪ মার্চ বিদেশে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানসমূহের বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বিডার নির্বাহী সদস্য অজিত কুমার পালকে সমন্বয়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিকে ‘বিদেশে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানসমূহের বিনিয়োগ নীতিমালা’র বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করতে এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিডার চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বিশ্বমানের কিছু উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এটা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে হয়েছে, ওষুধের ক্ষেত্রে হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের নতুন প্রজন্ম অনেক সক্ষম ও প্রতিভাবান। তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘ভারত ও অন্যান্য দেশ এ সুযোগ নিচ্ছে। আমরাও বিষয়টাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেখতে পারি। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সম্ভাবনাটাকে কাজে লাগাতে পারি।’
বৈঠকে উপস্থিত একটি সংস্থার প্রধান বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়; এটা সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। সরকারের ইঙ্গিত আছে বলেই এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো চাইলেই বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। যদিও ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে, অনুমোদন ছাড়াই অনেকেই অবৈধ পথে অর্থ নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের অনুমতি না দেওয়া হলে টাকা এমনিতেই চলে যাবে। এর চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেওয়াই ভালো। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কেনিয়া, কম্বোডিয়া, জর্ডানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের বেশ কিছু কারখানা হয়েছে। কাজেই এগুলোকে ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক করে নিতে পারলে খারাপ হবে না।
তবে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মন্দা, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয়ের শ্লথগতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতকে চাপে ফেলতে পারে। এই অবস্থায় সরকারের উচিত হবে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ নিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাপী যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে অথবা আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবর্তন দেখা যায়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত স্বস্তিজনক থাকবে না। আবার বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে টাকার বিনিময় হারের ওপর প্রভাব পড়ে কি না, সেটাও একটা দেখার বিষয়।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৪ মার্চ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে একটি চিঠি দিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছে। এ চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম। জ্বালানি তেল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যয় বাড়ছে এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় কমছে। ইতিমধ্যে রিজার্ভ থেকে ২০০ কোটি ডলার নিয়ে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনে সরকার সায় দিয়েছে, ২৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে দেশে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, বিনিয়োগের জন্য বিদেশে পাঠানো অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা, বিদেশে আয় করা মুনাফা দেশে আনা, টাকা নিয়ে গেলে তা ফেরত আসবে কি না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে আরও বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়ে বিনিয়োগ উৎসাহিত না করে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান সতর্ক বিবেচনার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এত বেশি হয়ে যায়নি যে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। আর দেশ যখন বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন বিদেশে বিনিয়োগের উদ্যোগ কেন? আর কে তদারক করবে?
তবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘বাংলাদেশের বাজার ছোট, এখানে একটি কোম্পানি বড় হয়ে গেলে আরেকটির গায়ে ধাক্কা লেগে যায়। বাংলাদেশে যারা সফল তাদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে ১ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১০ বছরে তারা ১০ গুণ নিয়ে আসতে পারবে।’
যারা অনুমোদন পেয়েছে: কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৩ সালের পর এখন পর্যন্ত রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) থেকে সাত প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। তার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের ডিবিএল গ্রুপ ইথিওপিয়ায় একটি পোশাক কারখানা নির্মাণ শুরু করেছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে তারা সেই কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে চায়। ডিবিএলকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যায়ক্রমে ৯৫ লাখ ডলার সেখানে নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া মবিল যমুনা মিয়ানমারে একটি প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। এসিআই হেলথকেয়ার যুক্তরাষ্ট্রে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ডলার ও স্কয়ার ফার্মা ৫০ লাখ ডলার নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে। ২০১৪ সালে এস্তোনিয়ায় বিনিয়োগের অনুমতি পায় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। যুক্তরাজ্যেও ১০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড বিনিয়োগে একটি নিজস্ব সাবসিডিয়ারি খুলেছে কোম্পানিটি।
আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় ইস্পাত কারখানা খোলার অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিল। প্রতিষ্ঠানটিকে শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) থেকে ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার কেনিয়ায় বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং পেয়েছে সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগের অনুমতি।
আরও যারা আগ্রহী: বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আকিজ জুট মিলস মালয়েশিয়ায় দুটি কোম্পানি অধিগ্রহণ করার জন্য ২ কোটি ডলার বিদেশে নিতে চায়। হা-মীম গ্রুপ হাইতিতে পোশাক কারখানা করতে ১ কোটি ডলার নিতে চায়। নিটল-নিলয় গ্রুপ গাম্বিয়ায় ব্যাংক স্থাপনের জন্য ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে চায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের আবেদন করেছে, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে শিপইয়ার্ড কারখানা স্থাপনের অনুমোদন চেয়ে সামিট গ্রুপের একটি আবেদন রয়েছে। কম্বোডিয়ায় জমি কিনে শিল্প স্থাপনের অনুমোদন চেয়েছে মেঘনা গ্রুপ। এ ছাড়া ভারতে কোম্পানি খোলার জন্য প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। বিদেশে আখনির্ভর চিনিকল স্থাপনের জন্য দেশবন্ধু গ্রুপ অর্থ নেওয়ার অনুমতি চেয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একজন রপ্তানিকারক ব্যবসা বাড়াতে অন্য দেশে লিয়াজোঁ বা সহযোগী অফিস খোলা ও ব্যয় নির্বাহের জন্য বছরে ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত নিতে পারেন।