‘ভীনদেশি মানুষেরাও আমার কাছ থেকে শাড়ি কেনে’
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
এমন একটা সময়ে তাঁতের শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তখন ফেসবুকে ছিল ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানি পোশাকের রমরমা। সুইটপটেটোর যাত্রা তাই যতটা না ছিল ব্যবসায়িক, তার চাইতেও বেশী সামাজিক দায়বদ্ধতার। আজ দেড় বছর পর সেই সুইটপটেটো নিজ দেশের মানুষের পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালি এমনকি ভিনদেশীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে সেই অসাধারণ রঙ এবং ডিজাইনের আরামদায়ক তাঁতের শাড়ি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী বলেই হয়ত সৃজনশীলতার প্রতি ঝোঁক, সেই আগ্রহই টেনে এনেছে সৃজনশীল এই ব্যবসায়। এক আড্ডায় উঠে এলো সুইটপটেটোর পিছনে স্বপ্ন ধারণ করা রোকসানা রশীদের কথা।
উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন কবে থেকে দেখা শুরু
ছোটবেলা থেকেই, আমি সব সময়ই চাইতাম ব্যবসায়ী হতে। মূলত আমার বাবার মত হতে চাইতাম, সেখান থেকেই ব্যবসায়ী হতে চাওয়া। বাবা বিমানবাহিনীতে ছিলেন, এরপর চাকুরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। আমার জন্মের আগের কথা এগুলো, ছোটবেলা থেকেই এই গল্প আমার মাথায় গাঁথা ছিলো, আমিও ক্যারিয়ারের প্রথম আড়াই বছর চাকুরি করে, এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী।
আপি আপনার স্কুল, ক্যারিয়ার—এসব নিয়ে যদি একটু বলতেন ?
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম, লেখক হতে চাইতাম। একটা বই প্রকাশিত হওয়ার পর লেখালেখিতে ইস্তফা। চাকরি করতাম একটা প্রোডাকশান হাউজে, বেশ কিছু আন্তর্জাতিক রিয়েলিটি শোয়ের ফ্রাঞ্চাইজি প্রতিষ্ঠান ছিলো, কাজ অনেক মজার ছিলো। এরপর সেই প্রতিষ্ঠানেরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের ইনচার্য হিসেবে পদন্নোতি পাই। এর এক বছর পর শখ থেকে দেশি তাঁতের শাড়ির ব্যবসা শুরু করি, দেড় বছর আগে। শুরুতেই বেশ ভালো সাড়া পাই, ফলে ব্যবসাতেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আর এই কাজে আমি একেবারে আমার নিজেকে খুঁজে পাই, ফলে পুরা পরিকল্পনাই দেশজ আবহে সাজাই।
সুইটপটেটোর যাত্রা শুরু কবে ? তাঁতের শাড়ি কী কোন প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি কিনেন নাকি নিজেই তাঁতের কাপড় কিনে কর্মীদের দিয়ে শাড়ি বানান?
সুইট পটেটো’র যাত্রা শুরু ২০১৪ এর এপ্রিল থেকে, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। শাড়ি সরাসরি তাঁতিবাড়ি থেকে আসে। মূলত সবই তাঁতিদের ডিজাইন। আমাদের তাঁতিদের কাজ এতো অসাধারণ, এখানে নতুন করে কিছু যোগ করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে অনেক সময় রঙ বা ডিজাইনের পরামর্শ দিই। যেহেতু আমার নিজস্ব তাঁত নেই, অর্থাৎ কোন তাঁতির তাঁতই ভরসা, তাই আমি কোন শাড়ির ডিজাইন দিলেও সেটা নিজের বলে দাবী করতে পারি না, এখানে কপিরাইটের ঝামেলা আছে। এছাড়া বাল্ক অর্ডার থাকলে ডিজাইন দেখিয়ে বানিয়ে নিই শাড়ি, তবে বেসিক ডিজাইন তাঁতিরই থাকে। নিজে তাঁত না পাতলে কোনভাবেই সেই ডিজাইন নিজের বলে দাবী করা যায় না। আর আমাদের দেশে বংশানুক্রমিকভাবে তাঁত পাতা হয়, ফলে বাইরের কেউ চাইলেই এর অংশ হতে পারে না, যদি না আড়ং বা এরকম কোন বড় প্রতিষ্ঠান না হয়।এর বাইরে নিজস্ব ডিজাইনের কিছু শাড়ি থাকে আমার কালেকশানে, যা আমি একটি শাড়ি একপিস করে বানাই, ওগুলো ব্লকের শাড়ি।
সুইটপটেটোকে যদি অন্য কোন অনলাইন শপের চাইতে আলাদা করে ভাবতে চাই, তাহলে এর কোন গুণটি অনন্য ?
আমি আসলে তুলনায় যেতে চাই না। কারণ দেড় বছর আগে আমি যখন ব্যবসায় আসার পরিকল্পনা করি, তখন ফেসবুকে ভারতীয় আর পাকিস্তানি পোশাকের রমরমা অবস্থা ছিলো। যেদিকে তাকাই বিদেশী কাপড়ের বিজ্ঞাপন। চোখে পড়ার মত রুচিশীল দেশি শাড়ির কোন ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসায়িক পেইজ অন্তত আমার চোখে পড়েনি। আবার গত ছয় মাসে আমার মনে হয়েছে প্রায় প্রতিটা মানুষই তাঁতের শাড়ির ব্যবসা করছে। এটা অবশ্যই ভালো, দেশি পোশাকের ট্রেন্ড সেট হওয়ায় বিদেশী কাপড়ের প্রতি আসক্তি কিছুটা হলেও কমেছে মানুষের। কিন্তু এসবের মাঝে সুইট পটেটো কি আলাদা বা অনন্য এটা আমি বলার চেয়ে আমার ক্লায়েন্টরা বললেই ভালো দেখায়। কারণ আমি তো আসলেই জানিনা, আমি কি অন্যদের তুলনায় ভালো সার্ভিস দিতে পারছি কিনা, বা আলাদা কিনা। যারা কেনে, তারাই বলতে পারবেন।
তবে একটি বিষয়ে আমি অবশ্যই গর্বিত, তা হলো, আমি দেশে যেভাবে হোম ডেলিভারি দিই, ঠিক একইভাবে দেশের বাইরে হোম ডেলিভারি দিই, প্রবাসী ক্লায়েন্টরা কোন বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই ঘরে বসে দেশি তাঁতের শাড়ি পেয়ে যায়। এবং বরফের দেশগুলোতেও যেরকম চাহিদা আমাদের সুতি শাড়ির, আমি সত্যিই অবাক হই, দেশি কাপড়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখে। এমনকি ভীনদেশি মানুষেরাও আমার কাছ থেকে তাঁতের শাড়ি কেনে, এই আনন্দ সহজ কথায় প্রকাশ করা যাবে না।
এই উদ্যোক্তা হবার পথে কোনো কটূক্তি, “না না, হবে না “ এইরকম বাঁধার মুখোমুখি হয়েছেন?
নাহ! শুরু থেকেই অনেক উৎসাহ পেয়েছি। ব্যবসার সূচনা হয় আমার হাজব্যান্ডের জমানো কিছু টাকা পুঁজি করে, আমরা দুইজনই ওউনার, আবার আমরাই কর্মী, এখনো এভাবেই কাজ চলছে। দুইজন মিলেই সব সামলাই। আমাদের দেশে একটা মেয়ে শাড়ির ব্যবসা করছে, এটার চেয়ে একটা পুরুষ শাড়ির ব্যবসা করলে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে। আমরা কোনরকম বাঁধা বিপত্তি, কটুক্তি কানেই তুলিনি।
পরিবার থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি, বিশেষ করে আমার মায়ের ভূমিকা স্বীকার না করলেই না। বাবার কাছ থেকে মানসিক শক্তি, উৎসাহ সব সময়ই পেয়ে এসেছি। ‘শাড়ি বেচাওয়ালা’ ধরনের কথা একবারই একজন বলার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে পাকা ছাগু হওয়ায় তার কথা ধরার প্রয়োজন মনে করিনি, কারণ এরা না বোঝে ঐতিহ্যা, না বোঝে রুচি। তাই হতাশ মানুষদের ঈর্ষা আমাদের চলার পথে কোন বাঁধাই সৃষ্টি করতে পারেনি।
সুইটপটেটোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলুন
যখন শুরু করি, আমার হাজব্যান্ডের স্বপ্ন ছিলো, দেশি তাঁতের হাতে বোনা শাড়ি আমরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবো। এখন দেড় বছর পর যখন পেছনে ফিরে তাকাই, দেখি সেই স্বপ্ন অনেকখানিই পূরণ হয়ে গেছে। এখন মসৃণভাবে একই গতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য, আপাতত বিশেষ কোন পরিকল্পনা নেই। এই যে রেমিটেন্সের যে টাকা আগে বিদেশী পোশাকে ব্যয় হতো, সেই টাকা এখন সরাসরি আমাদের দেশের তাঁতিরা পাচ্ছে, এই ধারাই সমানগতিতে চলতে থাকুক, এরচেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার আছে?
অনেক নারীর অনেক আইডিয়া আছে, পুঁজির অভাবে কিছু শুরু করতে পারে না , অনেকের সাহসেরও অভাব ! তাদের জন্য আপনার পরামর্শ।
পুঁজি ছাড়া ব্যবসা কখনোই সম্ভব না, অন্তত শুরু করলেও বেশিদূর আগানো যাবে না, পাশাপাশি ফ্যামিলি থেকে ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট থাকা জরুরী। ব্যবসা শুরু করতে গেলে অন্তত এক বছর বসে খাওয়ার মত বন্দোবস্তও করে রাখতে হবে, কারণ আপনি তো জানেন না, আপনার ব্যবসা কি আপনাকে ওঠাবে, না ডোবাবে। রিস্ক ফ্যাক্টর মাথায় রেখেই পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হওয়ার পরিকল্পনা করা উচিৎ। নাহয় সময়, রিসোর্স, এনার্জি সবকিছুরই অপচয় হবে।