নতুন উদ্ভাবন টেকসই করতে চাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা, শিল্পসহ সব খাতে নতুন ধারণা নিয়ে এগোতে হবে। অনেক তরুণ নতুন চিন্তা ও সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। এই তরুণদের যত্ন নিতে হবে। সৃজনশীল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে উদ্ভাবিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। কারণ, উদ্ভাবনকে টেকসই করতে হলে অবশ্যই তাকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করে তুলতে হবে। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি বড় শিল্প উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
‘উদ্ভাবন : চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বুধবার বক্তারা এসব কথা বলেন। দৈনিক সমকাল ও বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে। ঢাকার তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারহাত আনোয়ারের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, এসিআই লজিস্টিক লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান, মেট্রোনেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সাইয়েদ আলমাস কবির, স্পাইডার ডিজিটালের চিফ ইনোভেশন অফিসার কাজী মনিরুল কবির, ভিওলা ভিটালিসের সিইও কাদের আব্দুল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের ইনোভেশন স্পেশালিস্ট শাহিদা সুলতানা, এসএসডি-টেকের সিইও হাসান মেহেদি, হিসাব লিমিটেডের গ্রুপ সিইও যুবায়ের আহমেদ, তরুর প্রতিষ্ঠাতা সাইফ কামাল ও ডি নেটের চিফ ইনোভেশন অফিসার সিরাজুল হাশেম।
গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘আমরা প্রথাসিদ্ধ বিষয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। কিন্তু বিশ্ব অনেক এগিয়েছে। নতুন নতুন উদ্ভাবন বিশ্বকে পাল্টে দিচ্ছে। তাই আমাদেরও বদলাতে হবে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ সময়ে টিকে থাকতে হলে গণমাধ্যমকেও বদলাতে হবে। তাদের নতুন নতুন উদ্ভাবনী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশে সৃজনশীল অনেক কাজ হচ্ছে কিন্তু জনগণ জানে না। জনগণকে এসব জানানোর দায়িত্ব গণমাধ্যমের। সমকাল এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
মুস্তাফিজ শফি বলেন, ‘আমরা উদ্ভাবকদের জনগণের সামনে তুলে ধরতে চাই। যেন বাংলাদেশকে কেউ ছোট মনে না করে। অল্প সময়ের মধ্যে সমকাল একটি উদ্ভাবন মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে। যেখানে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে অংশ নেবেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উদ্ভাবকরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তারা অনেক যুগান্তকারী কাজ করছেন। অদূর ভবিষ্যতে তাদেরই কেউ কেউ নোবেল পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে সৃজনশীল কাজগুলো হচ্ছে সেগুলোর সমন্বয় করতে হবে। মিডিয়া শুধু নেতিবাচক সংবাদ দেবে না, সফলতার কথাও শোনাবে। সমকাল হবে মানুষের পত্রিকা। এ জন্য এবারের সমকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘সবার ওপর মানুষ সত্য’।
সাব্বির হাসান বলেন, ‘উদ্ভাবনকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্লোবাল ভ্যালু চেইন পরিবর্তিত হচ্ছে। শিল্পকারখানা পরিচালনায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশের পোশাক ক্রেতাদের অর্ডারের ধরন বদলাচ্ছে। বাজার ব্যবস্থা ই-কমার্সের দিকে ঝুঁকছে। ২০৩০-এর মধ্যে এর অনুপাত ৫০:৫০-এ দাঁড়াবে। এ জন্য বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অটোমেশনে যেতে হবে। নতুন নতুন উদ্ভাবনী আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ এর জন্য কতটুকু প্রস্তুত তা দেখতে হবে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ইনোভেশন হাব গড়ে তুলতে হবে।’
আলমাস কবির বলেন, অনেক নতুন আইডিয়া তৈরি হচ্ছে। সৃজনশীল প্রযুক্তি, পণ্য উদ্ভাবন হলেও টেকসই হচ্ছে না। এর কারণ, বড় বড় প্রতিষ্ঠান নতুন আইডিয়া নিতে চায় না। বিনিয়োগ না হলে নতুন আইডিয়া টেকসই হবে না। একই সঙ্গে উদ্ভাবনী কাজের জন্য মেধাস্বত্বের স্বীকৃতির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
মনিরুল কবির বলেন, সৃজনশীল উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে হলে দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন তা নেই। অনেক উদ্ভাবন প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কারণে অঙ্কুরেই ধ্বংস হয়ে যায়। কর্মীর উদ্ভাবনী শক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আনুগত্য পেতে বেশি পছন্দ করে। নতুন উদ্ভাবনের দায়িত্ব নিতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসে না। অথচ আমাদের পাশের দেশে নতুন উদ্ভাবনকে এগিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ রয়েছে।
সিরাজুল হাশেম বলেন, বাংলাদেশে উদ্ভাবনী চিন্তার প্রধান বাধা অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। ফলে দেশে উদ্ভাবনের চেয়ে অন্যের প্রযুক্তির অ্যাডাপ্টেশন বেশি। তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবায় উদ্ভাবনী চিন্তা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পারেন না তারা অসুস্থ। এ মানুষগুলো যদি প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকে তাহলে সহজে আধুনিক চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে অবগত হবে।
সাইফ কামাল বলেন, আমাদের পরিবারগুলো নতুন চিন্তা-ভাবনা গ্রহণ করতে পারে না। সন্তান প্রথাগত জীবিকার বাইরে নতুন কিছু করবে, বাবা-মা তা মেনে নিতে চান না। উদ্ভাবনী আইডিয়ার মাধ্যমে যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব তা তারা মানতে চান না। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যেসব আইডিয়া বেরিয়ে আসছে, সেগুলো আলোর মুখ দেখছে না। এর জন্য সরকারকে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। সমাজকে সচেতন করতে হবে।
যুবায়ের আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার অভাবে, দারিদ্র্যের কারণে নতুন নতুন আইডিয়া বের হয় না। তিনি বলেন, ২০৩০-এর পর উদ্ভাবনের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। মেশিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে। ভাবনার বিষয়, মানুষ প্রযুক্তির সক্ষমতাকে মেনে নেবে কি-না।
মেহেদি হাসান বলেন, জাপানে যারা নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবছেন তাদের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া হয়। জাপানে সব রকমের লজিস্টিক সুবিধাযুক্ত গবেষণাগার রয়েছে। সেখানে তরুণরা আসছে। তাদের আইডিয়া শেয়ার করছে। কোনো কোম্পানি উদ্ভাবন পছন্দ করলে উদ্ভাবকের সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গড়ে তুলছে। বাংলাদেশেও এরকম উদ্ভাবনী হাব গড়ে তুলতে হবে।
শাহিদা সুলতানা বলেন, সরকার নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে প্রচুর কাজ করছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু সরকারকে জনগণের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। সরকার এমন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে যেগুলো প্রান্তিক মানুষের কাজে লাগে। বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা উদ্ভাবনের মার্কেটিং। উদ্ভাবনগুলোকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, উদ্ভাবিত পণ্য যদি বাণিজ্যিকভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া না যায় তবে নতুন আইডিয়াটি মরে যাবে।
কাদের আব্দুল বলেন, তিনি যখন আর্সেনিক নিয়ে কাজ শুরু করেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতায় তা আটকে যায়। এ অবস্থায় তিনি অন্য একটি প্রকল্পের ওপর জোর দেন। সেই প্রকল্পের লাভের অংশ দিয়ে আর্সেনিক প্রকল্পটিকে এগিয়ে নেন। তাই নতুন উদ্ভাবকদের হতাশ হলে চলবে না। মনে জোর থাকতে হবে। তাদের উদ্ভাবনকে এগিয়ে নিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।