ডেইরিশিল্পে বিপ্লব
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
যশোর শার্শার উলাশিবাজারের পাশেই গড়ে উঠেছে তুহিনা বেগমের গরুর খামার। তিনি কোরবানি ঈদকে ঘিরে বিক্রি করার উপযোগী ৩৮টি গরু লালনপালন করছেন। এক যুগ আগে মাত্র ১২ হাজার টাকায় একটি গরু কিনে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। গত বছর কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করে আয় করেন ১০ লাখ টাকা। এবার আরও বেশি আয় করবেন। শুধু তুহিনা বেগমই নন, কোরবানি ঈদকে ঘিরে প্রস্তুত দেশের প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ ডেইরি খামার। এ শিল্প নিয়েই এই প্রতিবেদন।
দেশে ডেইরিশিল্পে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। গত ২০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে জোগান দিচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বছরজুড়ে মাংসের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ আসছে দেশীয় গবাদিপশু থেকে। দুধের চাহিদার প্রায় অর্ধেকটাই আসছে দেশীয় উৎস থেকে। আগে এগুলোর বেশিরভাগই ছিল আমদানিনির্ভর। লাভজনক হওয়ায় এখন পারিবারিকভাবে যেমন গবাদিপশু পালন বেড়েছে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও ডেইরি খামারের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে দেশে সোয়া পাঁচ লাখের বেশি খামার রয়েছে।
এ শিল্পের বিকাশের কারণে দেশে সহযোগী শিল্পও গড়ে উঠছে। এর মধ্যে রয়েছে দুধ শীতলীকরণ, পাস্তুরাইজেশন, প্যাকিং, দুধনির্ভর বিভিন্ন খাদ্যপণ্য। এ খাতকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহ এমরান বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে দেশের ডেইরি ফার্ম এগিয়ে চলেছে। দেশের বেশিরভাগ কৃষক পরিবার গরু পালনের সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়া দেশের শিক্ষিত বেকার তরুণরাও গরুর খামার তৈরিতে আগ্রহী। তাই গবাদিপশু দেশের কোরবানির ও দুধের চাহিদা পূরণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্প আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে।
একসময় যেখানে কোরবানির গরুর চাহিদা পূরণে ভারত থেকে গরু আনতে হতো। সেখানে এখন দেশের গরুর দিয়েই কোরবানির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। একই সঙ্গে পূরণ করছে দেশের দুগ্ধের চাহিদা। আর এর মাধ্যমে খামারিরা অর্থনীতিতে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে খামারের সংখ্যা প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ। দেশে এখন গরু আছে ২ কোটি ৩০ লাখ। এর একটি বড় অংশ গাভী ও কম বয়সী গরু বা বাছুর। এর মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ কোরবানির উপযোগী। এ ছাড়া ছাগল আছে ২ কোটি ৬০ লাখ, ভেড়া ৩৪ লাখ ও মহিষ ১৫ লাখ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে পশুসম্পদে। পশুসম্পদ ঘিরেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সৃষ্টি হচ্ছে। গত দুই বছর (২০১৫ ও ২০১৬) কোরবানির পশু বিক্রি করে কৃষকরা বেশ লাভবান হয়েছেন। তাই কৃষকরা গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও হাঁস-মুরগি লালনপালনে আরও আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তর্থমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ প্রাণীগুলো লালনপালন করতে গিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৯ হাজার ৮৯০ টাকার মূল্য সংযোজন করেছেন গৃহস্থরা। বর্তমানে এর পরিমাণ বেড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা প্রতিবছর সাড়ে ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০২১ সাল নাগাদ দেশের চাহিদা মেটাতে হলে উৎপাদন ন্যূনতমপে বছরে গড়ে ৬ থেকে ৯ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। কিন্তু ওই হারে উৎপাদন না বাড়ায় চাহিদায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ওই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি করে।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গরু লালনপালনে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এতে ওই বছর ৮ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা মূল্য সংযোজন হয়েছে। আর খামারপর্যায়ে ৪ লাখ ১০ হাজার ৭৯৯ গরু রয়েছে। খামারে গরু পালন থেকে ওই বছর মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ২৪৮ কোটি টাকা। ঢাকা বিভাগের মানুষ সবচেয়ে বেশি গরু পালন করে। এ বিভাগে মোট ৭৩ লাখ ৩৬ হাজার গরু রয়েছে। সবচেয়ে কম ১৬ লাখ ৬২ হাজার গরু রয়েছে সিলেটে।
দেশের অর্থনীতিতে গবাদিপশুর অবদান সম্পর্কে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশে এ শিল্পটি দিন দিন বড় হচ্ছে। তবে যতটা হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়নি। একই সঙ্গে গবাদিপশুর চাহিদা সারা বছর থাকলেও কোরবানি ঈদকে ঘিরে বেড়ে যায় কয়েক গুণ বেশি। এ সময় গরুকেন্দ্রিক অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ডেইরি ফার্মের সঙ্গে যুক্ত আছে কয়েক লাখ মানুষ। যার কারণে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া দেশের দুগ্ধের চাহিদাও পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ডেইরি ফার্মগুলো।
ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে দুধের উৎপাদন ছিল এক লাখ মেট্রিক টন। ২০০০ সালে উৎপাদন ছিল দুই লাখ টন। আর ২০১৬ সালে আমাদের হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন ৭২ লাখ টন। এ হিসাবে দেশে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৮০ লাখ লিটার দুধ। চাহিদা রয়েছে চার কোটি লিটারের।
এ বিষয়ে ফেনীর ফুলগাজীর খামারি খোন্দকার লোকমান হোসেন বলেন, একটি অস্ট্রেলিয়ান দুধেল গাভী দিয়ে শুরু করেন দুধের ব্যবসা। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার গাভী আছে ১৫টি। এসব গাভীর দুধ বিক্রি করে পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা।