আমি কেন অরগানিক খাবারের জন্য সংগ্রাম করি ?
- কাকলী খান
২০০৯ সালে আমার আপন ফুপু, যিনি আমার শাশুরিও ছিলেন; তিনি হঠাৎ করে কিডনির রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রোগ ধরা পড়ার মাত্র এক মাসেরও কম সময়ে তিনি মারা যান। তার চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সময়টুকু পাওয়া যায়নি। ফুপুর এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
ফুপু দারুণ একজন মানুষ ছিলেন। এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের সকালে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন আর বিকালে স্কুলের প্রচলিত সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদান করতেন। এলাকার কোনো মানুষ তার কাছে গেলে কখনো খালি হাতে ফেরত যাননি। আর এমন একজন ভালো মানুষ যিনি এভাবে চলে গেলেন, তার চলে যাওয়াটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। সেসময়ে পরিচিত ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে এই মৃত্যুর কারণ খুঁজতে থাকি। তখন মোটামুটি সবাই জানালেন ভেজাল খাবারের জন্যই এসব কিডনির সমস্যা, ক্যান্সারের সমস্যা এখন এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হলো ফুপুকে হারিয়েছি কিন্তু আর কোনো কাছের মানুষকে এভাবে হারাতে পারব না। তখন থেকেই পরিবারের সদস্যদের জন্য নিরাপদ খাদ্যের সন্ধান শুরু করলাম। কিন্তু ভেজাল খাবারের মাঝে বিষমুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করাটা আসলেই চ্যালেঞ্জিং মনে হলো। তখন মেহেরপুরের গাংনিতে এক আত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে ২১টি গরু কিনে গরুর খামার করলাম ভেজালবিহীন দুধ খাওয়ার জন্য। আর গরুর গোবর ব্যবহার করে সেখানেই নিজেদের জন্য সবজি চাষের চেষ্টা করলাম। কিন্তু একবছরের মধ্যেই এই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কারণ আমি ঢাকায় থেকে এই কাজটা চালিয়ে নিতে পারছিলাম না নানা কারণে। এরপর আলমডাঙ্গায় মামার বাড়িতেও সবজি চাষের চেষ্টা করলাম নিজেদের খাওয়ার জন্য। কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হলো।
এরপর পত্রিকায় বা সংবাদে কৃষিকাজের জন্য নতুন উদ্যোক্তা খুঁজতে লাগলাম। মজার ব্যপার হলো, আমার বাসায় যখন অরগানিক খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করতাম, যারা বিভিন্ন সময়ে আমার বাসায় খেয়েছেন, তারা খাবারের স্বাদে ভিন্নতা পেয়ে জানালেন, তারাও আমার মতো অরগানিক খাবারের ব্যবস্থা করতে চান। এভাবে ১৫-২০ জনকে পেয়ে গেলাম। তাই সাহস করে মিরপুরে একটা আউটলেট নিয়ে নিলাম অরগানিক খাবারের। সেখানে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেছে বেছে অরগানিক খাবার আনা শুরু করলাম। সমস্যা হলো এখানে পরিবহণ খরচ আর অন্যান্য খরচ মিলে আমার আউটলেটের দাম বাজারের সবজির চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়াতে আমাকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হলো। এক পর্যায়ে আমি এই আউটলেটটা আর চালিয়ে নিতে পারিনি। তবু আমি অরগানিক খাবারের এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারিনি। তখন আমি বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষকদের কাছে যাওয়া শুরু করি। তাদেরকে বীজ, প্রাকৃতিক জৈব সার সরবরাহ করি এবং অগ্রিম টাকা দিয়ে অরগানিক ফসল উৎপাদনের সার্বিক তদারকি করে অরগানিক ফসলের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করি।
আমার স্বামী মামুন খান চন্দন এই কাজে আমাকে ভীষণ সাপোর্ট করেন। চার বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে আমি সময় দিতে পারি না বললেই চলে! কারণ এই কাজে আমাকে সারা দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। তাই আমার স্বামী আমার মেয়েকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি মনে করি আমার একার কিংবা আমাদের কয়েকজনের চেষ্টায় এই আন্দোলন বাস্তবায়ন সম্ভব না। এজন্য সবার সচেতনতা এবং কৃষক ও উদ্যোক্তাদের পাশে সরকারের সহায়তা থাকতে হবে।’