বহুমাত্রিক সম্ভাবনায় ডেইরি শিল্প
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
দেশে তরল দুধের চাহিদা প্রায় পুরোটাই মেটায় দেশীয় খামারি ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো। এ খাতে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮টি বড় কোম্পানি। এরই মধ্যে প্রাণ ও মিল্কভিটা গুঁড়োদুধ তৈরির শিল্পও গড়ে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের প্রতিদিন ২৫০ মিলি লিটার দুধ পান করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের দুধ পানের পরিমাণ মাত্র ৪০ মিলিলিটার। তাহলে দুধের বাজার সম্প্রসারণে বাংলাদেশের সামনে বিরাট সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে দুধের চাহিদা প্রায় দেড় কোটি টন। অপরপক্ষে বছরে দুধ উৎপাদন হয় মাত্র ৬০ লাখ টন। চাহিদার অনুপাতে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৯০ লাখ টন। উৎপাদনের রেকর্ড উপাত্ত অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে- ২০০৯-১০ অর্থবছর দেশে দুধ উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২৩ লাখ ৬০ হাজার টন, ২০১০-১১ অর্থবছর তা ২৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০১১-১২ অর্থবছর তা হয় ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন। গত তিন বছরে তা আরও ২৫ লাখ টন বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬০ লাখ টন। সরকারের প্রণোদনা পেলে দুগ্ধ উৎপাদনের বৃদ্ধির এই ধারা দ্রুত বিকাশের পাশাপাশি দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে। সাশ্রয় হবে গুঁড়োদুধ আমদানির হাজার কোটি টাকা।
অনেকের ধারণা যে টাকা গুড়োদুধ আমদানিতে ব্যয় হয় অথবা সরকার আমদানি শুল্ক ছাড় দেয় তা যদি এই দুগ্ধ শিল্প বিকাশে প্রণোদনা বা ঋণ সহায়তা দেয়া হয় তাহলে দেশে দুধের ঘাটতি তো থাকবেই না বরং রফতানি করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে, দেশে দুধ উৎপাদনে চাহিদার প্রায় ৫৮ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে দুগ্ধ উৎপাদনের তুলনায় বিপুল ঘাটতি মেটাতে গুঁড়োদুধ আমদানিতে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। অথচ সরকার এ খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ সুবিধা দিলে একদিকে দুধের উৎপাদন বাড়বে, অপরদিকে আমদানি বন্ধ হলে বিপুল পরিমাণে বিদেশী মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে শুধু দুধ আমদানির ক্ষেত্রে। আর এই আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের কারণে দেশীয় দুগ্ধ শিল্পের বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর দাবি, দেশীয় শিল্পনীতিকে সহায়তা দিলে দেশের খামারি ও কোম্পানিগুলোই গুঁড়োদুধ ও তরল দুধের পুরো চাহিদা মেটাতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্যে দেখা যায়, গুঁড়োদুধ ও ক্রিম আমদানিতে ব্যয় হয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা টাকার হিসাবে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বিশ্লেষণ বলছে, বছর বছর আমদানি বাড়ার পেছনে ভূমিকা ছিল কর ছাড়ের। অথচ এই সুবিধা দেশীয় শিল্পকে দেয়া হলে দেশে ডেইরি শিল্প ভারতের মতো সাদা বিপ্লব ঘটাতে পারে। আমরা জানি, ভারতের সাদা বিপ্লবের জনক বলে খ্যাত, দেশটির বিখ্যাত দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি আমুলের প্রতিষ্ঠাতা ভারগিস কুরিয়েন (মৃত্যু ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২)। কুরিয়েনকে সারা বিশ্বেই দুগ্ধ শিল্পের বিকাশে অন্যতম পথিকৃত বলে মানা হয়। তার হাত ধরেই ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম গড়ে ওঠে। তার ভাবনা এবং পরিশ্রমেই ভারতে দুগ্ধ শিল্পের নয়া বিকাশ ঘটে, যা ‘সাদা বিপ্লব’ বলে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া কুরিয়েনের চেষ্টা এবং উদ্যোগেই ভারত বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। কুরিয়েন বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে, উন্নয়নের হাতিয়ারকে মানুষের হাতে তুলে দেয়া। আর এ নীতিতেই তিনি দুধ আমদানিকারক দেশ থেকে ভারতকে পরিণত করেছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুগ্ধসামগ্রী রফতানিকারক দেশে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে সিনোভ্যাটের জরিপে ভারতের শীর্ষ ব্র্যান্ড হয় আমুল। কাজেই ডেইরি শিল্পের বিকাশে বাজেটে দেশীয় দুগ্ধশিল্পের বিকাশে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত দুধের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটসহ সব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর প্রত্যাহার সহ ঋণ সুবিধা দিলে দুগ্ধ বা ডেইরি শিল্প বিকাশে দেশে বিপ্লব ঘটবে। তবে আশার খবর হলোÑ দুগ্ধজাত শিল্পের দৈন্য কাটাতে বিশেষ ঋণ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ খাতের উন্নয়নে বহুমুখী কর্মসূচীর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এজন্য গাভী পালনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দিতে কৃষি ঋণ নীতিমালায় আসছে পরিবর্তন। ইকুইটি এন্ট্রাপ্রেনিউর ফান্ড (ইইএফ) ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গাভী পালনে পুনঃঅর্থায়ন কার্যক্রমে ২০০ কোটি টাকার স্কিম চালু করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে নীতিগত সহায়তার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত চিঠিতে গাভী পালনে স্বল্পসুদে বিশেষ ঋণ কার্যক্রম চালুর জন্য উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী নীতিগতভাবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন।
দুধ উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে সাতক্ষীরা। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় গরুর খামার রয়েছে ১ হাজার ৯৯১টি। তার মধ্যে রেজিস্টার্ড ফার্ম রয়েছে ৯৫১টি। জেলার তালা উপজেলায় রয়েছে ৩০০টি গরুর ফার্ম। এর মধ্যে শুধু জিয়ালা গ্রামে রয়েছে ১৩৭টি ফার্ম। জিয়ালা গ্রামকে এরই মধ্যে দুধের গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন ৮ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। কলারোয়া উপজেলায় রয়েছে ১৫০টি গরুর ফার্ম। এখান থেকে প্রতিদিন ২২ হাজর ৪৩৫ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। আশাশুনি উপজেলায় খামার রয়েছে ৬০-৭০টি। এ উপজেলায় প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় ১৩ হাজার লিটার। সূত্র মতে, আমাদের দেশী প্রজাতির গাভী বছরে দুধ দেয় ৩ হাজার লিটার। সেখানে একটি বিদেশী গাভী দুধ দেয় ১০ হাজার লিটার। আমাদের দেশে অস্ট্রেলিয়ান জার্সি, ন্যাড়ামুন্ডো, হরিয়ানা ও সিন্ধি জাতের গাভী বেশি পালন করা হয়। আমাদের দেশে যদি কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকার মতো দেশ থেকে উন্নত জাতের বীজ আনা যায় সে ক্ষেত্রে খামার মালিকরা আরও বেশি উপকৃত হবে। তখন আরও বেশি দুধ উৎপাদন করা যাবে।