সম্ভাবনাময় বাইসাইকেল
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বিশ্বজুড়ে বাইসাইকেল অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় বাহন। নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব, স্বল্প খরচ এবং শারীরিক শ্রমবান্ধব এই বাহনটির সঙ্গে তারুণ্যের উন্মাদনার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। প্রযুক্তির প্রসারের এই যুগেও দিনকে দিন বাইসাইকেলের চাহিদা বেড়ে চলছে। সেই সঙ্গে বড় হচ্ছে সাহকেলের বাজার। বাংলাদেশে সাইকেল রফতানিতে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অর্জন করছে। প্রতিবছরই এ খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ক্রমাগত বিশ্বচাহিদা বৃদ্ধি এবং এ খাতের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীতে এর বাজার আরও বিস্তৃত হওয়ায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে সরকারও অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করছে।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা বাইসাইকেল বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এরমধ্যে মেঘনা গ্রুপ, জার্মান বাংলা, আলিতা, নর্থবেঙ্গলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তাইওয়ানের কোম্পানি আলিতা বাংলাদেশ লিমিটেড স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রফতানি শুরু করে। পরে এই ধারায় যুক্ত হয় মেঘনা গ্রুপ। বর্তমানে দেশের মোট বাইসাইকেল রফতানির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এটি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান কার্যালয়ের (ইউরোস্ট্যাট) তথ্য অনুসারে, রফতানিতে বাংলাদেশের পেছনে আছে ফিলিপাইন, চীন, তিউনিশিয়া, কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়া।
মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল বিদেশে রফতানি করছে। বর্তমানে ফ্রিস্টাইল, মাউন্টেন ট্র্যাকিং, ফ্লোডিং, চপার, রোড রেসিং, টেন্ডমেড (দু’জনে চালাতে হয়) নামের বাইসাইকেল রফতানি হচ্ছে। এসব সাইকেল তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রাংশ দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হলেও বেশির ভাগ যন্ত্রাংশই দেশে তৈরি হচ্ছে। ফলে সাশ্রয় ঘটছে অনেক বৈদেশিক মুদ্রার।
গত কয়েক বছরে যানজটের রাজধানীতে বাইসাইকেল ব্যবহারে ‘বিপ্লব’ ঘটেছে। তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ বাহনে পরিণত হয়ে উঠেছে বাইসাইকেল। মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস এবং পিঠে ব্যাগ নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর দ্বিচক্রযানে করে তরুণরা সারা ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় এখন অনেককেই সাইকেল চালাতে দেখা যায়। বোঝাই যাচ্ছে পরিচিত এই বাহনটির ব্যবসা এখন বেশ রমরমা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে দেশে সাইকেলের চাহিদা বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিপুল সংখ্যায় সাইকেল ব্যবহার করায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে সাইকেলের নতুন দোকান এবং সাইকেল বিক্রির চেইন স্টোর। বাড়তি চাহিদার কারণে দেশে সাইকেলের টায়ার-টিউবসহ খুচরা যন্ত্রাংশের কারখানাও গড়ে উঠেছে।
দেশে সাইকেলের বৃহত্তম পাইকারি বাজারে সারাক্ষণই ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে। গত কয়েক বছরে সাইকেল বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। বর্তমানে দুই চাকার এই যানের বার্ষিক চাহিদার পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ পিস। দেশীয় উৎপাদকরা সাইকেলের রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সাইকেলের সবচেয়ে বড় বাজার রাজধানীর বংশালে। সেখানে সাইকেলের প্রাায় ২০০ দোকান। ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা চার হাজারের বেশি। দেশের বাজারে কানাডা, ট্রেক, হিরো রেঞ্জার, ম্যাক্স, লক্স, জোহান, ফুজি ও তাইওয়ানের তৈরি মেরিডাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল পাওয়া যায়। কার্বন সাইকেল এক থেকে দেড় লাখ টাকা, এলুমিনিয়ামের সাইকেল ২১ থেকে ৭০ হাজার টাকা, ইস্পাতের বাইক ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
একসময় বাইসাইকেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল আমদানিনির্ভর। এখন উৎপাদন খরচ আর গুণগত মানের বিবেচনায় বাংলাদেশের বাইসাইকেল বিশ্ববাজারে রফতানির জায়গা করে নিয়েছে। ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশী সাইকেল পঞ্চম। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত বাইসাইকেল রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপ। বংশালের উদ্যোক্তাদের মতে ইউরোপের বাজারে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে বাইসাইকেল রফতানি করে কোটি কোটি ইউরো মুদ্রা বাজার দখল করা সম্ভব। বাইসাইকেল ছাড়াও এর বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ রফতানির সুযোগ রয়েছে ইউরোপের বাজারে।
বাইসাইকেল উৎপাদন শিল্পটি জ্বালানিনির্ভর না হওয়া এবং খুব বেশি প্রযুক্তিনির্ভর না হওয়ার কারণে দ্রুত বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের টায়ার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ইউরোপের বাজারে প্রায় ৫০ কোটি টাকার টায়ার রফতানি করছে। তাদের মতে, এখাত থেকে বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা রফতানি আয় বাড়ানো সম্ভব। আশার খবর হলো, বিশ্ব রফতানি বাজারে বাংলাদেশের বাইসাইকেল দিন দিন ভাল জায়গা করে নিচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রকৌশল শিল্পজাত পণ্য রফতানিতে বাইসাইকেলের অবদান ৭.৫ শতাংশ। প্রথম দিকে মাত্র কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান রফতানি শুরু করলেও বর্তমানে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাইসাইকেলসহ খুচরা যন্ত্রাংশ রফতানি করছে। মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল বিদেশে রফতানি করছে। বেশ কয়েকটি দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি সাইকেল। যেমন : যুক্তরাজ্য, জার্মানি, হল্যান্ড, ইতালি, গ্রীস, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম ডেনমার্ক, অস্টিয়া, পুর্তগাল ও কানাডা। জার্মানির বিখ্যাত পান্থারবাইক ব্র্যান্ডের একটি বাইসাইকেল কারখানা ঢাকার ধামরাইয়ে স্থানান্তর হয়েছে। ইউরোপের বাজারে শ্রমিকের মজুরি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা কোম্পানি স্মিংকে ইন্টারন্যাশনাল জিএমবিএইচ এ সিদ্ধান্ত নেয়। ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ-জার্মান যৌথ বিনিয়োগে নির্মাণাধীন কারখানায় প্রাথমিক অবস্থায় দেড় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। শুরুতে ৫ লাখ উৎপাদন টার্গেট থাকলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ক্ষমতা পৌঁছায় ১০ লাখে। এর সবই বাজারজাত করা হবে জার্মানি, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান পাওয়ারট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং উৎপাদন এবং জার্মান কোম্পানি স্মিংকে ইন্টারন্যাশনাল বাজারজাতকরণের দায়িত্ব পালন করবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথে এটিকে একটি বড় ধরনের অগ্রযাত্রা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত অর্থবছরে বাইসাইকেল রফতানি করে আয় হয় প্রায় ১২ কোটি ডলার। এখনও বাইসাইকেল রফতানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে টায়ার রফতানিরও সুযোগ রয়েছে। ইউরোপসহ ব্রাজিল ও তাইওয়ানে এসব টায়ার রফতানি হচ্ছে। বাইসাইকেলের বাজারের বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও আধুনিক প্রযুক্তির স্বল্পতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, অবকাঠামোগত সমস্যা, মূলধন সমস্যা ইত্যাদির কারণে কাক্সিক্ষত মাত্রায় এগিয়ে যেতে পারছে না। বাংলাদেশের শ্রমিকের মজুরী কম হওয়ায় সাইকেলের দাম বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। ফলে রপ্তানির সম্ভাবনাও বেশি। সরকারের উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ খাত এগিয়ে যাবে বহুদূর। সেই সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতিকেও।