শীতলপাটির অর্থনীতি
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
ঝালকাঠির শীতলপাটি শিল্প একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। এটি দেশের অন্যতম একটি কুটিরশিল্পও বটে। কথিত আছে, এককালে ঝালকাঠি পাটিশিল্পী সম্প্রদায়ের মেয়েদের খুবই কদর ছিল। একটি মেয়েকে ছেলের বৌ করে ঘরে আনতে সস্তার বাজারেও কয়েকশ টাকা পণ দিতে হতো। শীতলপাটির সূত্রপাত সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছেÑ প্রায় ৬০ বছর আগে বিশ্ব জনস্বাস্থ্য সংস্থার স্থানীয় পরিচালক আমেরিকাবাসী আরবুতনট ঝালকাঠি আসেন। তখন তাকে একখানা শীতলপাটি দেয়া হয়। এর বুননশৈলী দেখে তিনি খুশি হয়ে (তখনকার দিনে) ২০০ টাকা পুরস্কার দিয়ে এ শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেন। শীতলপাটিকে চিত্তাকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন ডিজাইন ও মোটিফ ব্যবহার করা হচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের উপকরণ হিসেবে শীতলপাটি ব্যবহার হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে।
ঐতিহ্য থেকে জীবিকায়ন
জানা গেছে, অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকে জেলার রাজাপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে শীতলপাটি বুননের কাজ শুরু হয়। ক্রমেই তা রাজাপুরের সাংগর, হাইলাকাঠি, নলছিটির সরই, বাহাদুরপুর, ঝালকাঠি সদর উপজেলার সাচিলাপুর, রামনগর, হরিশংকর, কাঁঠালিয়ার নীলগঞ্জ, হেলেঞ্চা, কাজলকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজলকাটি গ্রামের প্রায় ২০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রায় ১ হাজারটি পাইত্রা বাগান। একটু যত্ন নিলেই বছরের পর বছর পইত্রা পাওয়া যায়। গাছ বছরের পর বছর বেঁচে থাকে এবং ফলনও দেয়, নদী ও খালের তীরে জলাশয় ও নিচু জমিতে পাইত্রা ভাল হয়। অনেক পাটিশিল্পীরই নিজের পাটিবন নেই। আবার পাটিবন আছে এমন অনেকেই নিজেরা পাটি বোনার কাজ করেন না, তারা পাইত্রা বিক্রি করেন। এভাবে ক্রমশ অর্থকারী শিল্পে পরিণত হয় শীতলপাটি। এসব গ্রামে পরিকল্পিতভাবে পাইত্রা চাষ করা হয়। আর এই পাইত্রা দিয়েই তৈরি হয় শীতলপাটি। এ জেলার প্রায় ৬০০ পরিবার সরাসরি পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া পরোক্ষভাবে শীতলপাটির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে আরও অন্তত কয়েক হাজার পরিবার। পাটিবর বা পাটিকর হিসেবে এরা পরিচিতি লাভ করেন।
ঝালকাঠির শীতলপাটি
ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠিতে শত বছর ধরে তৈরি হচ্ছে শীতলপাটি। কর্মগুণে এই গ্রামকে শীতলপাটির গ্রামও বলা হয়। হাইলাকাঠি গ্রামে প্রতিটি পরিবার ব্যস্ত সময় পাড় করেন শীতলপাটি তৈরিতে। প্রথমে বন থেকে পাইত্ররা কেটে এনে রস ঝাড়ানো হয়। পরে তা বঁটি দিয়ে চিরে হাতে বেতি বানাতে হয়। তা ৫-৬ দিন ভাতের মাড় এবং পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই ভেজানো বেতি সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে পাটি তৈরি করা হয়। ছোট একটি পাটি আড়াই থেকে ৬ ফুট এবং বড় পাটি ৫ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সাধারণ শীতল পাটিতে ১-২ দিন এবং উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরিতে ৩-৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। শীতলপাটির মূল্য মাপ ভেদে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এখানকার শীতলপাটির কদর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়িয়ে এখন সুদূর প্রবাসেও। গ্রামের প্রায় ১ হাজার শ্রমিক পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এ গ্রামে বছরে ১০ হাজার ৫০০ পাটি তৈরি করা হয়, যা বিক্রি করে পাওয়া যায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
মুন্সীগঞ্জের পাটি হাট
জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আব্দুল্লাপুর আখড়া বাজারে প্রতি রোববার পাটির হাট বসে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররা পাটি কিনতে আসেন। এ হাটে পাটির বিক্রি হয় ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। প্রতি হাটবারে লক্ষাধিক টাকার পাটি বিক্রি হয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের পাটি পাওয়া যায়, যেমন: শীতলপাটি, নকশি পাটি ও সাধারণ পাটি। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলা ও সিরাজদিখান উপজেলার সুয়াপাড়া গ্রামে, টঙ্গীবাড়ির পাইকপাড়া, বাঘিয়া ও কামাড়খাড়া এবং সিরাজদিখান উপজেলার ভাটিমভোগ, বয়রাগাদি, তালতলার পাশের আরমহল গ্রামের কারিগররা এখনও এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। টঙ্গীবাড়ির আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের পাইট্টাল বাড়ি এ অঞ্চলে সবচেয়ে পাটি উৎপাদনকারী এলাকা। পাইটাল বাড়ির ঐতিহ্য কয়েকশ বছরের। বংশ পরম্পরায় ৪০০ বছর ধরে তারা পাটি উৎপাদন করে আসছে। এখানে বর্তমানে রয়েছে ৬০ থেকে ৭০টি পরিবার। পাটি তৈরির সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা চার শতাধিক।
দরকার সরকারের নজর
কাঁচামাল ও পুঁজির অভাবে ঝালকাঠির শীতল পাটিশিল্প বিলুপ্তির পথে। এখানে তৈরি উন্নত মানের মসৃণ শীতলপাটি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দেশের চাহিদা পূরণ করে তা রফতানি হতো ভারত, মায়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পাটিশিল্পীদের নিরাপত্তা বিধান, ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় শীতলপাটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেয়া হলে গার্মেন্টস শিল্পের মতো পাটিশিল্পেরও বিকাশ সম্ভব। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, এশিয়া মহাদেশের গ্রীষ্মম-লীর দেশগুলোতে শীতলপাটির বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব হলেই এ শিল্পটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং রফতানিযোগ্য পণ্য হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো।