মাছের খনি : হালদা নদী

মাছের খনি : হালদা নদী

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় ৮০০ নদীর মধ্যে চট্টগ্রামের ছোট্ট একটি নদীর নাম হালদা। শুধু নামে নয় গুণেও অনন্য আমাদের এই হালদা নদী। স্মরণাতীতকাল থেকে হালদায় রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ ডিম ছেড়ে আসছে।যুগে যুগে হালদা নদী অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনায় বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য হালদা নদী বাংলাদেশের জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদারও বটে। প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি হালদা- বিশ্বের একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী এবং এশিয়ার প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।


মৎস্য অর্থনীতিতে হালদার অবদান

হালদা নদী বাংলাদেশের সাদা সোনার খনি হিসেবেও পরিচিত। এ নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয়, যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস।একটি মা মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে আয় করা যায়। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিটি ধাপে ৪০ শতাংশ মৃত্যুহার বাদ দিয়ে হিসাব করলে একটি মা কাতলা মাছ প্রতি বছর হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার। এই হিসেবে হালদার প্রতিটি মা মাছকে একেকটি প্রাকৃতিক এগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রি বলেও অভিহিত করছেন হালদা গবেষকরা। তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে- হালদায় এক সময় ৭২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত।মৎস্য অধিদফতরের সংকলন-২০১৩ থেকে জানা যায়- হালদা থেকে ১৯৪৫ সালে সংগৃহীত ডিম ১,৩৬,৫০০ কেজি এবং ৬৫ বছর পর ২০১১ সালে সংগৃহীত ডিম ১৩০৪০ কেজি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরে চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ।

সম্ভাবনার হাতছানি

একক নদী হিসেবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান সবচেয়ে বেশি। হালদাকে আঁকড়ে থাকা প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবারসহ জড়িয়ে আছে বিশ হাজার মানুষের জীবিকায়ন।ডিম ছাড়ার উপযোগী প্রতিটি ডিম দেয় একসঙ্গে ৫ থেকে ৪০ লাখ পর্যন্ত। বর্তমানে হালদা নদীতে মিঠা পানির ডলফিনসহ ৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। জানা গেছে, পঞ্চাশের দশকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগেরও বেশি পোনার চাহিদা পূরণ করত হালদা।হালদা বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অনুযায়ী, হালদার ৫ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা একটি মাছ থেকে বছরে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

হালদা হতে পারে মেকং

হালদাকে তুলনা করা যেতে পারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী মেকং-এর সঙ্গে। মিয়ানমার, চীন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড যৌথভাবে একটি সমন্বিত নদী কমিশন গঠন করে মেকং নদীতে মৎস্য চাষের মাধ্যমে তাদের সারা বছরের মাছের চাহিদা পূরণ করছে। নবেম্বর থেকে মে পর্যন্ত মাছ ধরার জন্য মেকং নদী উম্মুক্ত করে দিলে জেলেরা নদী থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করতে পারছে। আমাদের প্রশ্ন- আমরা কেন দেশের অভ্যন্তরের মাছের খনি হালদা, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীতে বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মাছ শিকার বন্ধ করে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পারছি না। মৎস্য অধিদফতর, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং মাননীয় সরকার কি ভাবছেন?

হালদাকে বাঁচাতে হবে

মৎস্য বিজ্ঞানীদের অভিমত, হালদার বাঁকগুলোতে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। বাঁকের পানি ওলট-পালটের মাধ্যমে মা মাছের সঙ্গে পুরুষ মাছের শুক্রাণু ভালভাবে মিশ্রিত হয়। কিন্তু বাঁক কেটে নদীর স্রোত বৃদ্ধি পাওয়ায় মা-মাছের নিরাপদ প্রজননস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি ডিম সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক পদক্ষেপের অভাব, মা-মাছ শিকার, বালু উত্তোলন, নদীর বাঁক কাটাসহ মাছের খনি হালদা নদীর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দূষণের শিকার হয়ে মহাসংকটের সম্মুখীন। হালদা সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকে সচেতন করা এবং মৎস্য বিভাগকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করলে বিশ্বের একমাত্র এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি টিকে থাকবে।

লেখক : এস এম মুকুল

Sharing is caring!

Leave a Comment